সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। এর জন্য কোন “ইজম”এর দলদাস অর্থনীতিবিদের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই। যাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উন্নয়নের মাপকাঠি করেছে সেই বিভিন্ন “প্রকল্পে” “অনুদান” পাওয়া মানুষের সংখ্যা এই রাজ্যেই সর্বাধিক! এমনকি সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘প্রজাপতি’ সিনেমায় এইসব “সাথী” প্রকল্প প্রাপকদের নিয়ে তির্যক মন্তব্য করা হয়েছে! এছাড়া আরেক মাপকাঠি – রাজ্যে উৎপাদনকারী সংস্থার জিএসটি প্রদানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় নীচের সারিতে।
এই দুই মাত্রার মাপকাঠিতে বলা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক দৈন্যতা অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ব্যাপারে সমালোচনার রাজনীতিতে কারুর কোন লাভ নেই। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের উত্থানের নেপথ্যে কেন্দ্রের বঞ্চনা অর্থাৎ তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারের বিমাতৃসূলভ আচরণের প্রচার অনেকটাই দায়ী। কিন্তু, আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এই বামপন্থীরাই সেই কংগ্রেস (তাদের নীতিতে কোন মৌলিক পরিবর্তন না হলেও) দলের সঙ্গে মিলিতভাবে রাজ্যে ও কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের মিলিজুলি রাজনীতি করেছে! আবার বর্তমানে দেশের ক্ষমতায় থাকা জাতীয়তাবাদী দল একই সঙ্গে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র বসুকে আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রনেতা হিসাবে মানে! এ ত সুবিধাবাদী রাজনীতি! যাদের মত ও পথ বিপরীতমুখী, তাদের মধ্যে মেলবন্ধনের চেষ্টা সুবিধাবাদের রকমফের মাত্র।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অবস্থার চিত্র শুধু রাজ্যের মানুষের নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের পক্ষে ভয়াবহ। শিক্ষা-দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ আধিকারিক, যারা শিক্ষা-দপ্তরে শিক্ষকসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা সকলেই জেলে! রাজ্যের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জেলে! এদের অপরাধের তদন্ত চলছে উচ্চ- আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় এজেন্সীদের দ্বারা। সারা দেশ জানে, এরা সবাই শিক্ষক নিয়োগ সহ বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে টাকার বিনিময়ে মেধা ও পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে অযোগ্যদের নিয়োগ করার দায়ে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের প্রায় সকলের হেফাজত থেকে হিসাব বহির্ভূত সম্পত্তি উদ্ধার হয়েছে বলে সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশ। একটি ব্যাপারের উল্লেখ করতে হয় যেটাকে সংবাদ-মাধ্যম ও সামাজিক-মাধ্যম গুরুত্ব দিচ্ছে না! তা হল, অপরাধমূলক কাজের সঙ্গেসঙ্গে এ ধরনের অপরাধ সমাজের জন্য অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং উদ্বেগজনক অপরাধ! সমাজে দুটি সুদৃঢ় স্তম্ভের উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি – শিক্ষক, যার কাজ চরিত্র গঠন সহ শিক্ষার আলোকে সমাজকে শিক্ষিত করা এবং চিকিৎসক, যাদের হাতে সমাজের স্বাস্থ্য নির্ভর করে। যদি শিক্ষক নিয়োগে টাকার বিনিময়ে জাল শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, তবে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই নষ্ট হয়ে যায়। তার অবিসম্বাদী ফল হল পুরো জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া। কারন, শিক্ষাই পশুর সঙ্গে মানুষের তফাৎ গড়ে দেয়। এই দুর্ণীতিতে সমাজে শিক্ষকদের এবং সেইসঙ্গে রাজ্যের শিক্ষা-ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতাই কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এটা রাজ্যের শাসন-ব্যবস্থার চরম অবক্ষয়ের লক্ষণ। রাজ্যের প্রাচীনতম এবং সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে আইন না মানার কারনে ঐ উপাচার্যকে উচ্চ-আদালতের নির্দেশে বরখাস্ত হতে হয়। আরো কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারও আদালতে বিচারের অপেক্ষায়। শিক্ষা-বিভাগে এই মূহুর্তে একজন শিক্ষা-মন্ত্রী থাকলেও জনমানসে রাজ্যের শিক্ষা-দপ্তরের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে। বর্তমান শিক্ষা-মন্ত্রীর আমলে সাম্প্রতিকতম শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার দুর্ণীতি ও অনিয়মের প্রমাণ সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় দপ্তরের নতুন ‘মাথা’দের বিশ্বাসযোগ্যতাও তলানিতে। এ ব্যাপারেও ধরা পড়েছে রাজ্যের শাসকদলের এক “নেতা”! এমন অবস্থায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের কাজকর্মে ঢিলেমির জন্য উচ্চ-আদালতের একাধিক ন্যায়াধীশ বারংবার তাদের তিরষ্কার করেছেন! তবু তারা নির্বিকার! এটা তখনই সম্ভব যখন এই তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাদ্বয় বিশেষ কোন কারনে তদন্তে ঢিলে দিতে বাধ্য হয়! মনে রাখতে হবে, যদিও তদন্ত চলছে আদালতের নির্দেশে, এই সংস্থাদের প্রশাসনিক কন্ট্রোল কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। আবার শিক্ষা – সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ দায়িত্বে থাকায় রাজ্যের শিক্ষা-দপ্তরের এমন হালের পরেও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাদের এমন ঢিলেমি নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে। এখনো পযর্ন্ত যে অভিযুক্তদের হেপাজতে নেওয়া হয়েছে তারা সকলেই রাজ্যের শাসকদলের নেতা বা নেতা-নেত্রী ঘনিষ্ঠ। সুতরাং এই দুর্ণীতিতে শাসদলের নেতা-নেত্রীর যোগ যেমন প্রমাণিত, তেমনি রাজ্যের বিরোধী দল, যারা কেন্দ্রের শাসক দল, তাদের নিয়ন্ত্রিত সংস্থাদের এমন ঢিলেমির দায় কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়ার রহস্যময় ইঙ্গিত দেয়!
শুধু শিক্ষা-দপ্তরের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও – যেমন কয়লা পাচার কেলেঙ্কারী, অবৈধ বালি পাচার, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে গরু পাচারের মত তদন্তেও ঢিলেমির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে! রাজ্যের দুর্ণীতির বিরুদ্ধে পুরো অনুসন্ধান প্রক্রিয়াই যেন দুধ-ভাত খেলা হয়ে যাচ্ছে! এতে শুধু এই সংস্থারাই নয়, পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। হয়ত, কেন্দ্রে সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতাদের হিসাব-নিকাশ বলছে – আগামী ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে ভোট কাটাকাটির অঙ্কে পশ্চিমবঙ্গের সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে কয়েকটি রাজ্যে কেন্দ্রের শাসক দলের কাছে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসবে অনুমান করে কেন্দ্রের শাসক দল পশ্চিমবঙ্গে এই মূহুর্তে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষপাতী! মনে হয়, তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিরোধী দলের রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী!
সারা দেশে অনুদান রাজনীতির প্রভাব কম-বেশী থাকলেও তার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক। “শ্রী” যুক্ত এবং “শ্রী” হীন অনুদান রাজনীতির কারনেই রাজ্যের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু এ রাজ্যে বাণিজ্যিক লগ্নীর পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম, সেজন্য পশ্চিমবঙ্গে অবকাঠামো (infrastructure) উন্নয়ণের চাহিদা প্রায় নেই! তা সত্ত্বেও এখানে অবকাঠামো উন্নয়ণ দুরের কথা, রক্ষণাবেক্ষণ পযর্ন্ত ঠিকমত হচ্ছে না। আসলে এই রাজ্যে এত বেশী দুর্ণীতির অভিযোগ, তার কারনে এখানে লগ্নিকারীরা আসতে সাহস পাচ্ছেন না। সকলের বক্তব্য, রাজ্যে লগ্নি করার পর রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে ফেঁসে যেতে হবে না ত! প্রকৃষ্ট উদাহরণ – সিঙ্গুরে টাটাদের পশ্চাদপসরন।
এমন পরিস্থিতিতে চাকরি-বাকরি থেকে ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজ্যের সাধারণ মানুষের সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারি চাকরি বিক্রি ও যে কোন প্রাপ্য সার্ভিসের বিনিময়ে ‘কাটমাণি’ নেওয়ার অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় যেটা স্বাভাবিক পরিণতি, সেদিকে যদি রাজ্যটা চলে যায় তবে তার দায় কার? অর্থনৈতিক বিকাশে বারবার বাধা ধীরেধীরে পুরো সমাজকে অসহিষ্ণু অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয় – যার খন্ডহার এখন বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে। একে “গোষ্ঠী সংঘর্ষ” বা “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” বলে কতদিন ধামাচাপা দেওয়া যাবে! এইসঙ্গে একটি ব্যাপার খেয়াল রাখা দরকার – পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়েছে এক বিশেষ ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে এবং জন্মের পর থেকেই এই রাজ্যের মানুষকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত রেখে, ধর্মীয় “ইজম” এর ধোঁয়া তুলে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ই রাজনৈতিক ফয়দা তুলেছে। একটি ব্যাপার লক্ষণীয় – এই রাজ্যে সর্বদা সংসদীয় রাজনীতিতে শাসক ও বিরোধী – দুই ভাগে মানুষের সমর্থন বিভক্ত থেকেছে। অথচ, প্রথমে কংগ্রেস ও তারপর যুক্তফ্রন্টের শাসনকালের পর রাজ্যের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। কারন বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই রাজ্যে বামফ্রন্টের বকলমে সিপিএমের শাসন কায়েম হওয়ার পর তাদের দুটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত পশ্চিমবঙ্গকে দেশের অন্যান্য রাজ্যের থেকে পৃথক অবস্থানে নিয়ে গেল। তারা দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মানের পরিকল্পনা থেকে সরে গিয়ে শস্তা জনপ্রিয়তার রাজনীতির দিকে paradigm shift করল। প্রথমে কৃষি-জমি বিল এনে রাজ্যের সব চাষ-আবাদের জমিকে ভেঙ্গে দিল এবং রায়তদের জমির মালিকানা পাওয়ার আইনের ফলে বড় ও একলপ্তে থাকা কৃষিজমি আর রাজ্যে রইল না। জমির ঊর্ধসীমা সিলিংএর আইনে হয়ত রাজনীতিতে সিপিএমের সমর্থন বাড়ল; কিন্তু সেইসঙ্গে চাষের কাজে আধুনিকীকরনের সুযোগ বন্ধ হল। আধুনিক, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক চাষের জন্য একলপ্তে যে পরিমাণ জমির প্রয়োজন, রাজ্যে আর তা রইল না। এখানে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তা “শ্রেণী-সংগ্রাম” বলে প্রচারের সুযোগে রাজ্যে সমবায় আন্দোলন দানা বাঁধল না। নিট ফল হল, প্রতি হেক্টর জমিতে একই জাতের ফসল ফলনের নিরিখে পঞ্জাব, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে অনেক এগিয়ে গেল। দ্বিতীয় হল শিল্পক্ষেত্র – যেখানে অযৌক্তিক দাবী তুলে শ্রমিকদের সংগঠিতভাবে দলীয় সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় তাদের মালিকের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে একেএকে শিল্প, কারখানা বন্ধের রাজনীতি শুরু হল। বেকার শ্রমিক ও অভুক্ত কৃষকদের নিয়ে দলীয় সংগঠন স্ফীত করতে সক্ষম হলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আর্থ-সামাজিক অধোগতি শুরু হল। তখন, এইসব বিপুল সংখ্যক দলীয় সমর্থকদের (ক্যাডার) পুষ্টিকরনের উদ্দেশ্যে পঞ্চায়েত রাজ চালু হল। উন্নয়ণের নামে এই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সরকারী অর্থ খরচের বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হল। সুতরাং দল তথা সরকারে বাফ্রন্টের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখার প্রয়োজনে যেন-তেন-প্রকারেন পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার জন্য রিগিংয়ের সাথে বলপ্রয়োগ শুরু হল – এর জেরে নির্বাচনে হিংসার আমদানি হল। তার রূপায়নের তাগিধে রাজ্যের প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যবহার করা শুরু হল।
রাজ্যের মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভ প্রশমিত করার সঠিক দিশা না পেয়ে রাজ্য নেতৃত্ব তখন “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ্যে কুস্তি” নীতির সফল রূপায়ন করল! এই নীতির সফল রূপকার নিঃসন্দেহে জ্যোতি বসু। যেহেতু সংসদীয় রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সর্বদা দ্বিমেরুভিত্তিক রাজনীতি সমর্থন করে এসেছে, সেজন্য মানুষের কাছে ভোটের সময় বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের বিকল্প তৈরী হল না! এই রাজনীতির শিকার পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ যেমন হল, তেমনই তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের পশ্চিমবঙ্গে ধ্বংসের পথ সুগম হল। রাজনৈতিক চালাকি এই রাজ্যের মানুষের না-পসন্দ। এই অবস্থায় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে লড়াকু নেত্রী মমতা ব্যানার্জী ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ দল গঠন করে নির্বাচনী ময়দানে সিপিএম ও কংগ্রেসের বিকল্পর সন্ধান দিলেন। এই দলের জন্মের পর থেকে সিপিএমের উপর মানুষের অনাস্থার কারনে তৃণমূল দল নির্বাচনে ছাপ রাখতে শুরু করল। নির্বাচনে জেতার জন্য ছাপ্পার সঙ্গেসঙ্গে নির্বাচনী ও নির্বাচনোত্তর হিংসা ক্রমশই বাড়তে লাগল। পশ্চিমবঙ্গের সব নির্বাচনে হিংসা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ভোট ময়দানে স্বীকৃত টেকনিক হিসেবে দেখা দিল! এসবের সবচেয়ে বড় কারন হল, সিপিএম রাজত্বে এই রাজ্যের বড় অংশের মানুষের রুজি-রোজগার ছিল রাজনীতির ছত্রছায়ায় তোলাবাজি ও বিভিন্ন অবৈধ পাচারের পথে উপার্জন! ফলে, রোজগার হারানোর ভয়ে এরা হিংসার আশ্রয় নিয়ে হলেও দলকে নির্বাচনে জয়লাভের রাস্তায় নিয়ে যেত। তৃণমূল দলের শুধুমাত্র বামফ্রন্টের বিরোধীতার জন্য জন্ম হলেও, বামফ্রন্টের শেষ মূখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের ভুল নীতির পরিবর্তনের চেষ্টায় দলেরই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হন, বিশেষতঃ যারা অসৎ উপায়ে রোজগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক নেতৃত্ব “কুস্তি-দোস্তি”র রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, সেই নীতির প্রয়োগে মমতা দেবী তাঁর তৃণমূল দলকে ২০১১র সাধারন নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ সাহায্যে রাজ্যের ক্ষমতায় নিয়ে এলেন।
ক্ষমতায় আসার সঙ্গেসঙ্গে তৃণমূলের সিপিএম বিরোধীতার লড়াই শেষ হল! তখন প্রশাসন চালানোর জন্য মমতা দেবী সিপিএমের রাস্তায় আরো উগ্রতা ও ব্যাপ্তির সঙ্গে রাজ্যকে নিয়ে এলেন। তিনি যথার্থ সিপিএমের মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তাঁর শাসন এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তৃণমূল দলটি ব্যাক্তি মমতা নির্ভর দল হওয়ায় এরা দ্রুত ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সিপিএম জমানার হিংসা, তোলাবাজি ও অবৈধ পাচারের অর্থসংগ্রহকে বিপুল মাণ্যতা দিয়ে অল্প সময়েই রাজ্যের হাল শোচনীয় করে তুলল। যেহেতু পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা “কেন্দ্রে দোস্তি, রাজ্যে কুস্তি” নীতিতে অভ্যস্ত, মমতা ব্যানার্জীও সেই কায়দায় রাজ্য চালানোর চেষ্টা করতে লাগলেন!
পশ্চিমবঙ্গ একটি আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায় এবং এখানে ভারত-বিরোধী জিহাদী অনুপ্রবেশের প্রচুর ইতিহাস আছে। ভোটের তাড়নায় মমতাদেবী সিপিএমের থেকেও অনেক বেশী জিহাদী তোষণ করতে লাগলেন ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে। এখন কিন্তু রাজ্যের সাধারণ ইসলামী নাগরিকরা তাঁর এই অভিসন্ধি ধরে ফেলেছেন। ফলে, তাঁরা যত তৃণমূল দলের থেকে সরে যাবেন, ততই রাজ্যে মাথাচাড়া দেবে সিপিএম ও কংগ্রেস জোট। কারন তাদের সঙ্গে আতাঁত রয়েছে ISF এর। হয়ত, রাজ্যের বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে মমতা ব্যানার্জীর দল lesser enemy তত্ত্বের নিরিখে কম ক্ষতিকারক মনে হতে পারে, কিন্তু রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, কংগ্রেস দল এই খেলা খেলতে গিয়ে রাজ্যে রাজনৈতিক হারিকিরি করেছিল। তাছাড়া, এখনকার আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং সীমান্তবর্তী রাজ্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অচিরেই পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিতীয় কাশ্মীর বানাতে পারে। ইলাস্টিককে বারবার টানাটানি করলে তা একবার যখন বড় হয়ে যায় তখন আর ব্যবহারযোগ্য থাকে না। অতয়েব সাধু সাবধান।
ভাবের ঘরে চুরি : রাজনীতির শিকার পশ্চিমবঙ্গ
