ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে শুধু রাজ্য বা দেশেরই নয়, বিদেশ থেকেও অনেক বিশেষজ্ঞ তাঁদের বক্তব্য রেখে থাকেন। আমার মত আম আদমিও সেসব পড়ে “কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ” করতে পারিনা। কারন প্রতিটি লেখা – বিশ্লেষণ, সব কিছুই লেখকের রাজনৈতিক চিন্তাধারার আঙ্গিকে লেখা – একপেশে ও পক্ষপাতদুষ্ট। সেজন্য বহু সুধীজনের অনুরোধে এই বহুল চর্চিত বিষয়ের উপর লিখতে বসলাম। আমার লেখা পক্ষপাতদুষ্ট কিনা তার বিচারের ভার রইল পাঠকমন্ডলীর উপর।
পশ্চিমবঙ্গে এই মূহুর্তে রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা বলা হলেও তেমন কোন কিছু আমার মনে হয়না। এই মূহুর্তে এ রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন কাম্য নয়। আমার ধারনা, এবিষয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার সহমত পোষণ করে। সেজন্য, যদিও প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের ভাষণবাজী আর রাজনীতির তরজা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই চালিয়ে যাচ্ছে, কোথাও রণংদেহী ভাব একটি পর্যায়ে গিয়ে তারপর আলাদিনের দৈত্যের মত উধাও হয়ে যাচ্ছে। এখানে এই রাজনীতির বিশ্লেষণ করতে গেলে অনেকটা পিছনে যেতে হবে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতের রাজনীতির ধরন খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, আমরা ভারতীয়রা আমাদের রাজনৈতিক চেতনা একটি বিশেষ দিকে প্রবাহিত হতে দিয়েছি। ভারতীয়দের মধ্যে সকল ধর্ম নির্বিশেষে ব্যক্তি অর্চনা বা ব্যক্তি পুজনের প্রথা সর্বদা গুরুত্ব পেয়েছে। আধুনিক খন্ডিত ভারত তার ব্যতিক্রম নয়। ১৮৫৭র প্রথম বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম কিন্তু ভ্রান্তভাবে “সংঘবদ্ধ বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম” হিসেবে দেখানো হয়। তান্তিয়া টোপী, নানা ফড়নবীশ থেকে ধরে মঙ্গল পান্ডে ইত্যাদি সকলেই তাঁদের অনুচর বা অনুগামীদের নিয়ে – আলাদা আলাদা কারনে বৃটিশের বিরুদ্ধে অসন্তোষ থাকায় তার প্রতিবাদে লড়াই করেন। কিছু তাৎক্ষনিক যোগাযোগ ছাড়া এই প্রতিবাদকে ভারতব্যপী সংঘবদ্ধ বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম বলা যায়না। আসমুদ্রহিমাচল ভারতবাসীর মধ্যে প্রথম বৃটিশ বিরোধী সংঘবদ্ধ আন্দোলন যার নেতৃত্বে শুরু হয় তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। গান্ধীজিই নিঃসন্দেহে প্রথম নেতা যিনি ভারতীয় মননে বৃটিশ বিরোধী হাওয়া তুলতে পেরেছিলেন। অবশ্য তাঁর মত ও পথ নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে – যদিও এখানে তা আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের ভারতীয়দের ধর্মই হল আমাদের নেতাকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যা ব্যক্তি পুজনের জায়গায় পড়ে – নেতার ছবি স্বপনে, মননে পুজো করা! আর এই ধরনের personality cult সর্বদাই নেতৃত্বকে স্বৈরাচারী মনোভাবের দিকে ঠেলে দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সে কথাই বলে। গান্ধীজির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। সাভারকর, ভগৎ সিং, সুভাষ চন্দ্র বসু, জওহরলাল ও মহম্মদ আলী জিন্না – এমন অসংখ্য উদাহরন আছে যেখানে গান্ধীজির দৃষ্টিবঙ্গি ও ব্যবহারের পরিবর্তন হলে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস অন্য খাতে বইত। এই ব্যক্তি পুজনের বিরুদ্ধে যখন ব্যক্তি বিশেষের প্রতিবাদ সফল হয়, তখন নতুন নেতার ব্যক্তি পুজন শুরু হয়। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সময় থেকেই স্বাধীন ভারতে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মধ্যেই নতুন নেতার ব্যক্তি পুজনের নানা ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। জিন্নার ক্ষেত্রেও এমনটি হতে পারত, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁর পাকিস্তানের নেতা হওয়ার পিছনে যে ধর্মীয় মৌলবাদের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল; সেই শক্তিই তাঁর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে গেল। জিন্না অবশ্য তাঁর অকালমৃত্যুর কারনে এই লড়াই চালানোর সুযোগ পাননি। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তানের অস্তিত্ব দুটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে – যে দুটির অবদানও জিন্নার। একটি হল ধর্মীয় মৌলবাদ ও অন্যটি তীব্র, বিজাতীয় ভারত বিদ্বেষ। যেহেতু ভারতবর্ষ ভেঙ্গে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে, সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই সেখানে অন্য কোন নীতিতে রাষ্ট্র চালিত হওয়ার কথা নয়। তবে, প্রাক্তন পূর্বপাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশ যখন ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় স্বাধীন হয়, তখন সেটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ‘ নামে আত্মপ্রকাশ করলেও এই উপমহাদেশের ইসলামী শাসনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রক্তক্ষয়ী ব্যক্তিহত্যা ও মৌলবী প্রাধান্যের ইসলামী গনতন্ত্রে (!) পরিণত হয়। সেখানে গোঁড়া, অসহিষ্ণু ইসলামী মতবাদের সঙ্গে সহনশীল তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ দেখার চেষ্টাও করা হয়। এই কারনে ইসলামী নীতির আলগা প্রয়োগ করা বাংলাদেশে ব্যক্তি পুজনের রাজনীতি গভীরভাবে দাগ কাটতে পারেনি। তবে একথা অনস্বীকার্য যে তাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকে এখনকার শেখ হাসিনা অব্দি যে যখন ক্ষমতার শীর্ষে থেকেছেন, তাঁর দলবল সর্বদা এই ব্যক্তি পুজনের চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
এবার আসি আমাদের ভারতের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কথায়। জওহরলাল তাঁর ১৯৫১-৫২ সালের জয়লাভের পরে পরেই স্তাবকবাহিনীর একটি বড় অংশকে মন্ত্রীত্বসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসেন। এর প্রথম উদ্দেশ্য হয়ত মন্ত্রীসভা ও প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রীর আনুগত্য নিশ্চিত করা। তবে একাজ করতে গিয়ে যোগ্যতার বদলে ব্যক্তি আনুগত্যের উপরে বেশী জোর দেওয়া হয়। তার ফলে ঐ ক্ষমতাশালী মানুষজন তাঁদের ক্ষমতার মধুভান্ড বহাল রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তৈলমর্দন অবশ্য ও একমাত্র কর্তব্য মনে করেন। এভাবে জওহরলালের প্রধানমন্ত্রীত্বের বিশেষ করে শেষ দশ বছর ভারতের রাজনীতিতে চাটুকারিতা এবং ব্যক্তি পুজন এক নতুন মাত্রা পায়। সেই শুরু। তারপর লালবাহাদুর শাস্ত্রীর স্বল্প সময়ে পাক
সঙ্গে যুদ্ধ সামলে তাসখন্দে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু – এছাড়া বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ও অটলবিহারী বাজপেয়ীর জোট সরকারের বাধ্যবাধকতায় এই ব্যক্তি পুজনের রাজনীতি তার উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর দুই পর্যায়ে এবং রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বে এই ব্যক্তি পুজন এমন এক মাত্রা পেল যে পুরো শাসক দলের মালিকানা চলে গেল একটি পরিবারের হাতে! এই সময় ভারতের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের যে রমরমা শুরু হল, তা এখনো পুরোপুরি চলছে। বিভিন্ন রাজ্যে প্রাদেশিক সুলতানের মত ব্যক্তি পুজনের মাধ্যমে নেতা তাঁর পরিবারকে রাজনীতির মধ্যে এনে উত্তরাধিকারকে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কোথাও স্ত্রী, ছেলে বা মেয়ে আবার সেসব না থাকলে জামাই বা ভাইপো – মোদ্দাকথা হল রাজনীতির ক্ষমতা ও অর্থ পারিবারিকভাবে কুক্ষিগত করা ‘জনসেবা’র মোক্ষ উদ্দেশ্য! নেতা বা নেত্রীর বড় বড় কাটআউটকে সাধারন মানুষের কাছে বাবা, মা বা দিদি হিসাবে দেখানো ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান রূপ। এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের সরকারগুলির যেখানে পরিবারতন্ত্রের শাসন (অবশ্যই গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে) নেই, সেখানেও এই ব্যক্তি পুজনের চরিত্র পুরোপুরি বর্তমান। ছোট ছোট বৈশিষ্ট উল্লেখ করা যেতে পারে। নেতা বা নেত্রীর জন্মদিনে শুধু সংবাদ মাধ্যমগুলিতেই নয়, সামাজিক মাধ্যমেও দলের বিভিন্ন পদাধিকারী – এমনকি মন্ত্রী মহোদয় বা মহোদয়া অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে মন্ত্রীসভার প্রধান ও অন্যান্য প্রভাবশালীদের এমনভাবে বন্দনা করেন যে, সুস্থ চেতনা সম্পন্ন মানুষজনের মনে হবে নিম্নমানের তৈলমর্দন-প্রতিযোগীতা হচ্ছে! গণতন্ত্রে জনগনের সেবার জন্য নির্বাচিত মানুষজন যদি তাদের নৃতৃত্বকে এমনভাবে তোল্লা দেন তাহলে নেতৃত্বের মনে হতেই পারে যে তারা জনগনের সেবক নন – জনগনের মসিহি বা ভগবানের অবতার হিসেবে তারা জনগনের সেবা পাওয়ার হকদার।
এইভাবে আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনীতির একটটি ধারা তৈরী হয়েছে। এখানে মানুষ ভোট দিয়ে মানুষের সেবার জন্য যাদের নির্বাচিত করেন, তাদের গণতান্ত্রিক নিয়মকানুনের মধ্যেই তৈরী হওয়া একনায়কতন্ত্রী কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের তথা সমাজের উন্নয়নের পরিপন্থী হয়। এর প্রথম ও প্রধান কারন হচ্ছে প্রশাসন ও মন্ত্রীত্বে এবং অন্যান্য ক্ষমতাশালী পদের জন্য চয়নের মাপকাঠি হল চাটুকারীতার ক্ষমতা – তাদের পদের জন্য যোগ্যতা কোন নির্নায়ক বিষয় নয়। এর ফলে সমস্ত জায়গায় অযোগ্য মানুষের ভিড়! আবার আমলাদের কাজের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের ফলে এবং অযোগ্য নিয়োগে প্রশাসনের কর্মদক্ষতা প্রশ্নের মুখে। এভাবে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় স্তরেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকার সৈরাচারী রূপ ধারন করে – তার বিরুদ্ধে স্বজনপোষন, দুর্ণীতি ও খুনখারাবি সহ বিভিন্ন অভিযোগ আসে। ক্ষমতায় থাকার সময় বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুর্ণীতি ও অত্যাচারের মাত্রাও বাড়তে থাকে। তখন স্বৈরাচারী, ব্যক্তিপুজনে অভ্যস্ত সরকারের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের টেকনিক পাল্টায়। এই টেকনিক পাল্টানোর ব্যপার বামফ্রন্টের পরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা তৃণমূল দল, বিশেষতঃ, তাদের সুপ্রিমো মমতাদেবী অত্যন্ত সুচারু দক্ষতায় সম্পন্ন করার ক্ষমতা রাখেন। দীর্ঘ সময়ের দুর্ণীতি ও অপশাসনের নিষ্পেষনে সাধারণ মানুষের অবস্থা কেমন হয়েছে তাবুঝে নিয়ে তিনি কল্যানকর একনায়কতন্ত্রের (benevolent dictatorship) একটি উৎকৃষ্ট নমুনা পেশ করেন। যেহেতু মানুষের কর্মসংস্থান ও অন্নসংস্থান অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন, মমতাদেবী বিভন্ন রকমের কল্যানকর প্রকল্পের নামে মানুষকে সরাসরি সরকারি অনুদান দিয়ে শুধু মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বন্ধ করলেন তাই নয়, মানুষের কাছে তাঁর ইমেজ যথেষ্ট বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হলেন। ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের বাজেটের দিকে তাকিয়ে দেখলে এই ব্যপারটা পরিষ্কার হয়। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট থেকে ধরে সমস্ত রকমের উন্নয়ন বন্ধ। এমনকি পরিকল্পনাখাতে অনেক প্রজেক্ট কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদনের পরেও রাজ্যসরকার ম্যাচিং গ্র্যান্টের লায়াবিলিটি নেওয়ার অপারগতায় বন্ধ বা ধুঁকছে। এর ফলে পরিকল্পনা বহির্ভূতখাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি বিভিন্ন নামের অনুদান প্রকল্পে দান খয়রাতি করে ভোট কিনে নিজের জনপ্রিয়তা এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সমর্থ হলেন। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, স্বাস্থসাথী থেকে হালের স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড, লক্ষ্মীর ভান্ডার, বার্ধক্যভাতা এর সাক্ষ্য বহন করছে। আর এইসব করতে গিয়ে তিনি সরকার ও সরকার পোষিত বিভিন্ন সংস্থায় পুরো সময়ের নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে সেখানে অ্যাডহক ও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে প্ল্যান্ড এক্সপেন্ডিচার থেকে এই টাকা সরিয়ে নিয়ে আনপ্ল্যান্ড এক্সপেন্ডিচারে নিয়ে গিয়ে অনুদানের বহর বাড়িয়ে নিজের তথা দলের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে চলেছেন।
কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের রাজ্য নেতারা এসবের সমালোচনা সমালোচনা করলেও তার কোন প্রভাব জনমানসে পড়ছেনা। কেন? কারন মমতাদেবীর অনুদান বিলানো যেমন সংবাদমাধ্যমে ব্যপক প্রচার পাচ্ছে, তেমনি কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অনুদান নীতি দেখে মনে হয় তারা যেন পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অনুদান প্রতিযোগীতায় নেমেছে! মমতাদেবী যদি ব্যক্তিপুজনের রাজ্যস্তরের উদাহরণ হন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে যা হচ্ছে সেটাও নিঃসন্দেহে ব্যক্তিপুজন। এক্ষেত্রে দেশের উন্নয়ণ যে ব্যহত হচ্ছে তাই নয়; দেশের অর্থনীতিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে – মূল্যবৃদ্ধি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। উজালা গ্যাসের ভর্তুকির টাকা গুনতে গিয়ে মধ্যবিত্তের রান্নার গ্যাসের মাসিক খরচ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। অনুৎপাদক বিলাসিতায় সেই কল্যানকর একনায়কতন্ত্রের মধ্যে নিজের image building এ মেতে দেশের প্রধানমন্ত্রীও এক অঙ্গরাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন – আপাতদৃষ্টিতে এটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু না, বিষয়টা খতিয়ে পর্যালোচনা করলে ব্যপার পরিষ্কার হয়ে যাবে।
ভারতীয় রাজনীতির ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক ক্ষমতাসীন রাজনীতিক চান তাঁর কুর্সীর উপর দখলদারি অক্ষয় হোক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুর্ণীতি ও অপশাসন দেশের সরকারি প্রশাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয়ায় জনগণের মনে ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার হওয়া স্বাভাবিক। রাস্তায় কান পাতলে রাজনৈতিক সাধারণ মানষের কাছ থেকে যা শোনা যায় তার নির্গলিতার্থ অর্থ হল, “যেই যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ”! এই ক্ষোভ যাতে ক্ষমতাসীন দলের উচ্চতম নেতৃত্বকে স্পর্শ করতে না পারে, তার জন্য সুচারুভাবে তাদের ইমেজ বিল্ডিং করা হয় – এতে পেইড সংবাদ মাধ্যমগুলিও প্রভূত সাহায্য করে। ফলে, সরকারের সর্বাধিনায়ক বা সর্বাধিনায়িকাকে প্রায় দেব-দেবীর পর্যায়ে উন্নীত করে ব্যক্তিপুজন শুরু হয়। কিন্তু শুধু কথায় ত আর চিঁড়ে ভেজে না। তখন শুরু হয় ‘অনুদান’ নামক সরকারি অর্থ বালানো। এই কাজে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের শীর্ষস্থানীয়দের একই রকম স্বার্থ জড়িত থাকায় তাঁরা একে অন্যকে মানিয়ে চলেন! কখনোই এক নেতা অন্য নেতাকে রাজনৈতিকভাবে ‘খতম’ করেন না। ভারতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে এই ‘সেটআপ’ কায়েম থাকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ। আর রাজনীতিতে নেতৃত্বের পথ সুরক্ষিত করতে বলিপ্রদত্ত রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। যেদিন দেশ ও রাষ্ট্র এই ধরনের কুটিল, নেতৃ-স্বার্থভিত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে জনগনদ্বারা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, সেদিন আমাদের রাজনৈতিক সুদিন আসবে।
ভারতীয় গণতন্ত্রে ব্যক্তি পুজা
