ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমরা যেমন পৃথিবীর কাছে আমাদের দেশকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে মেলে ধরেছি, তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্পকলায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছি। ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্ব ও উৎকর্ষতা প্রাচীন যুগে এতটাই লক্ষণীয় ছিল যে, প্লিনী অনুযোগ করেন – আর্যাবর্ত দেশ তাদের কাছে বড়লোক, রাজারাজরাদের ব্যবহারের জন্য মূল্যবান ও বহু দুর্মূল্য সামগ্রী রপ্তানীর মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করছে! আমরা গুপ্তযুগে নির্মিত যে বিশাল লৌহ মিনারটিকে বানিয়েছিলাম – যেটি কুতুব মিনারের বাগানে ফেলে রাখা আছে – প্রায় দেড়হাজার বছর আগের তৈরী হলেও তাতে একটুও মরচে ধরেনি! ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ঢালাই কারখানাগুলি একশ বছর আগেও এমন মিনার বানানোর কথা কল্পনা করতে পারত না। আমাদের দেশের মসলিন কাপড় বানানোর শিল্পকে ইংরেজ বণিকের দল পশুসুলভ হিংস্রতায় ধ্বংস করেছে। আবার আমাদের নতুনভাবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
আমরা অনেকেই বলে থাকি, ইউরোপ, আমেরিকা চিকিৎসাবিদ্যায়, বিশেষতঃ অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় অনেক উন্নত – আমাদের আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র তাদের থেকেই শেখা! এমন একটি myth ভেঙ্গে দেওয়া দরকার। কিছু ডিগ্রিধারী মূর্খ আমাদের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি – আয়ুর্বেদ সম্পর্কে না জেনে উন্নাসিকতা দেখাতে গিয়ে এমন ধারনা ব্যক্ত করেন। আমরা যখন কোলকাতার ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ক্লাস করতাম, তখন রিজেনারেটিভ মেডিসিনের একজন প্রফেসার ক্লাসে প্রায়শঃ বলতেন, আধুনিক অ্যালোপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মধ্যে প্রভূত মিল আছে। তিনি আরো বলতেন, সার্জারী এবং অ্যনাটমীর ক্ষেত্রে দুটোই এক। তিনি অবশ্য ইউনানী ও হোমিওপ্যাথিকে বিদ্রুপ করতেন।
এবার আসি আয়ুর্বেদশাস্ত্র কিভাবে আমাদের দেশে উৎকর্ষতা লাভ করে এবং আয়ুর্বেদ থেকেই অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার উৎপত্তি হল বলছি কেন তার বিস্তারিত আলোচনায়। ভারতীয় সভ্যতার আদি জ্ঞানভান্ডার হল বেদ। ঋগ্বেদ থেকে আমরা প্রথম জানতে পারি চিকিৎসা শাস্ত্রের দেবতা ধন্যন্তরীর কথা। অথর্ববেদে সার্জারীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। Xenotransplantation (পশুর অঙ্গ মানুষের দেহে সংস্থাপন) এর প্রয়োগ করেছিলেন স্বয়ং ধন্যন্তরী অর্থাৎ বিষ্ণু (ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী)। ভগবান গণপতি এই প্রতিস্থাপনের প্রথম সফল প্রয়োগ।
অর্ধশিক্ষিত মূর্খরা যুক্তিজাল বিস্তার করে বলতেই পারেন – এসব ইতিহাসের প্রামাণ্য তথ্য নয়। তাদের বলি, পৃথিবীর ইতিহাস শুরু হয়েছে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম বা মহম্মদের মদিনা যাত্রার সময় থেকে কি! ইতিহাস পৃথিবীর জন্মের পর মূহুর্ত থেকে শুরু। কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত ইতিহাস কিন্তু ইতিহাস নয়, প্রচারের হ্যান্ডবিল। যাদের এসব স্বীকার করতে বাধা আছে তাদের বলি, আধুনিক বিশ্ব পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যাকে তিনি হলেন চরক – তাঁকেই আয়ুর্বেদের জনক বলা হয়েছে। তিনি কাশ্মীরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর রচিত ‘চরক সংহিতা’ চিকিৎসাশাস্ত্রের আদি গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। চরক সংহিতা প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যে রচিত। এতে মোট আটটি বই মিলিয়ে ১২০টি অধ্যায় আছে। বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে চরক সংহিতা কোন একজন মানুষের রচনা নয় – শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির ফসল। বইগুলির বিষয়ে আরো বিশদে আলোচনা করলে বোঝা যাবে, প্রাচীন আয়ুর্বেদের সঙ্গে বর্তমান অ্যালোপ্যাথির তত্ত্বের তফাৎ বিশেষ নেই।
এবার বলি, চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রাথমিকভাবে দুটি বিভাগ – মেডিসিন ও সার্জারী বা শল্য চিকিৎসা। আমরা একাধিক বেদে সার্জারীর উল্লেখ পাই। এই সার্জারীর, বিশেষতঃ প্লাস্টিক সার্জারীর জনক হিসেবে বিশ্বে যিনি পরিচিত, তিনিও একজন ভারতীয় – সুশ্রুত। প্রামান্য নথি থেকে ধারনা করা যায় যে, সুশ্রুতের মৃত্যু হয় ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। সুশ্রুতের সুশ্রুত সংহিতায় মোট ১৮৬টি অধ্যায় আছে। যেখানে ১১২০ রকমের অসুখ এবং ৭০০ রকমের মেডিক্যাল প্ল্যান্ট, ৬৪ রকমের আকরিক উৎসের ও ৫৭ রকমের প্রাণী উৎসজাত ওসুধ তৈরীর বিবরণ বর্নণা করা হয়েছে। তাঁর বইটি মেডিসিন ও সার্জারীর শিক্ষার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। সুশ্রুত সংহিতায় সার্জারীকে বিশেষ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ছেদ্য (excision), লেখ্য (sacrification), ভেদ্য (puncture), এস্য (exploration), আহর্য (extraction), স্বরায্য (evacuation), এবং সিব্য (suturing)। শুধু ৬০ রকমের ঘা সারানোর উপকর্মের কথা লিখেছেন। এমনকি তিনি reconstruction ও প্লাস্টিক সার্জারীর কথাও বিশদে লিখেছেন। ৩০০ রকমের বিভিন্ন সার্জারীর কথা তিনি লিখেছেন। ১২০ রকমের সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টের কথাও তাঁর বইতে পাওয়া যায়। সুশ্রুত সুষ্ঠুভাবে সার্জারীর জন্য অ্যনাস্থেসিয়া – মদ, henbane (cannabis indica) প্রয়োগের উল্লেখ করেছেন। তিনি কর্তিত নাকের রোগীয নাকের সার্জারী (rhinoplasty) করতেন। এছাড়া ছেঁড়া কান জোড়া দেওয়া (autoplasty) ও ছানি অপারেশান করতেন। এজন্যই তাঁকে প্লাস্টিক সার্জারীর জনক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়, সুশ্রুত সংহিতার সংকলন নেপালের কাইজার লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে। এটি ১২-১৩ শতাব্দীতে তালপাতার পুঁথিতে লেখা। এখনকার যে চিকিৎসাগুলি আমরা বিদেশ থেকে ধার করি, সেগুলি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ও শল্যচিকিৎসার কথা সুশ্রুত লিখে গেছেন। এর মধ্যে আছে রক্তধাতু সঞ্চালন, রসধাতু (lymph), হৃৎসুলা (heart pain), মধুমেহ, স্থূলতা ও উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগের চিকিৎসা। কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার কথাও সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত আছে। কিডনীর পাথর বের করার শল্য চিকিৎসার কথাও এখানে বলা আছে।
যদিও খ্রীষ্টপূর্বাব্দে চরকের চিকিৎসার উল্লেখ পাওয়া যায়, তা নিয়ে বিভ্রান্তির কোন কারন নেই। প্রথমতঃ, চরক শব্দের অর্থ ‘ভ্রাম্যমান চিকিৎসক’। এখানে আরেকটি কথাও অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত – চরক সংহিতার প্রকাশকাল দ্বিতীয় শতাব্দীতে হলেও তা একাধিক মানুষদ্বারা গ্রন্থিত। এই ধারা হিন্দু সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন হিন্দু-চিকিৎসাবিদ্যা, যা আয়ুর্বেদ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত, তা কোন একজন মানুষের রচনা নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গবেষণা ও চিকিৎসাবিদ্যার গ্রন্থিত সংকলন। নিঃসন্দেহে এবিষয়ে প্রথম প্রামাণ্য রচনা চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতা। সে কারনেই বেদেও আয়ুর্বেদ চিকিৎসার উল্লেখ পাওয়া যায়। যদিও ৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সুশ্রুতের মৃত্যু হয়, পরবর্তীকালে আরো অনেকে সুশ্রুত সংহিতায় অধ্যায় সংযোজন করেন। তেমনি আত্রেয় ঋষির তত্ত্বাবধানে অগ্নিবেশ অষ্টম খৃষ্টপূর্বাব্দে অগ্নিবেশ সংহিতা রচনা করেন – যার পূর্ণাঙ্গরূপ দেন চরক। জন্ম হয় চরক সংহিতার। চরক সংহিতায় মোট আটটি বই – ১২০টি অধ্যায়। এরমধ্যে শেষ দুটি বই – কল্পস্থান ও সিদ্ধিস্থান এবং সর্বমোট ১৭টি অধ্যায় দৃধবলা সংযোজন করেন।
চরক সংহিতার বইগুলি ও তার অধ্যায়ের কথা জানলে সবাই বুঝতে পারবেন, আমাদের আয়ুর্বেদ আধুনিকরূপে পরিবর্তিত হয়েছে অ্যালোপ্যাথিতে। চরক সংহিতার বইগুলি হল –
১) সূত্রস্থান (৩০টি অধ্যায়) – আলোচ্য বিষয় সাধারণ নীতি, চিকিৎসা দর্শন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
২) নিদানস্থান (৮টি অধ্যায়) – প্যাথোলজি, রোগের কারণ।
৩) বিমনাস্থান (৮টি অধ্যায়) – রোগ নির্দিষ্টকরণ, চিকিৎসকদের ট্রেণিং, নীতিশাস্ত্র (ethics), পথ্য ও ওষুধের স্বাদ।
৪) শরীরস্থান (৮টি অধ্যায়) – শরীরবিদ্যা (anatomy), এমব্রায়োলজি।
৫) ইন্দ্রিয়স্থান (১২টি অধ্যায়) – সংবেদনশীল অঙ্গজনিত পূর্বাভাস – বিশেষতঃ রোগীর সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সণাক্তকরণ।
৬) চিকিৎসাস্থান (৩০টি অধ্যায়) – থেরাপিউটিকস্, রোগের চিকিৎসা ও ওষুধ।
৭) কল্পস্থান (১২টি অধ্যায়) – ওষুধ প্রকরণ বিষয় (pharmaceutics) ও বিষবিদ্যা (toxicology)।
৮) সিদ্ধিস্থান (১২টি অধ্যায়) – চিকিৎসার উৎকর্ষতা,আরোগ্যের লক্ষণ, স্বাস্থ্যবিধি সম্মত সুস্থ্য জীবনযাত্রা।
এই দুটি সংহিতা বিশদে পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা, যাদের অধিকাংশ ইউরোপ, আমেরিকার, অবাক বিস্ময়ে আয়ুর্বেদের বৈজ্ঞানিকধারার প্রাচীন ভারতের এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
এবার আসি আয়ুর্বেদিক ওষুধের সঙ্গে বর্তমানের অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের মিল-অমিল বিষয়ে। এ ব্যপারে প্রথমেই বলি, চিকিৎসাশাস্ত্রে আয়ুর্বেদিক ওষুধের উপকারীতা আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞান অস্বীকার করে না। অল্প কিছু উদাহরণে ব্যপারটা পরিষ্কার হবে। অশ্বগন্ধার (withania somnifera) মূল-এ ক্লান্তি, বেশ কিছু চর্মরোগ, মধুমেহ, গেঁটে বাত (rheumatic arthritis) এবং বেশ কিছু পেটের রোগসহ কয়েকপ্রকারের ক্যান্সারের উপশম হয়। সর্পগন্ধা (raulfia serpentina) উচ্চ রক্তচাপ আয়ত্তে রাখে। নয়নতারা (canthranthus roseus) এখনো ক্যান্সারের চিকিৎসায় সারা বিশ্বে ব্যবহার করা হয়। এতে ভিনব্লাস্টিন ও ভিনক্রিস্টিন অ্যালকালয়েড পাওয়া যায় – এই দুটি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার নয়নতারা গাছের মূলসহ সমস্ত গাছেরই বিষক্রিয়া আছে। অশোধিত মূলে এমন অ্যালকালয়েড পাওয়া যায়, যেমন ভিনডোলিন, যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধির সহায়ক। প্রায় সব আয়ুর্বেদিক ওষুধের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। সে কারনে গাছের কোন অংশকে সরাসরি ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় না। আয়ুর্বেদে তার জন্য উপযুক্ত ‘শোধন’ এর নিদান দেওয়া আছে। তাকে আধুনিক চিকিৎসার পরিভাষায় isolation and purification বলে। এখানেই যত গোলমালের সুযোগ। এই শোধনক্রিয়ার কথা কিন্তু কোথাও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা নেই। এর একমাত্র কারণ, ইচ্ছাকৃতভাবে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ও ওষুধের বিলুপ্তি ঘটানোর চেষ্টা। আমরা যেসব ওষুধ প্রস্তুতির প্রাচীন ছবি দেখি সেখানে রিটর্ট ও সক্সলেট জাতীয় যন্ত্রপাতি, যা আধুনিক সময়ে ওষুধের isolation and purification এ ব্যবহার করা হয়, সেসবের উপস্থিতির প্রমাণ পাই। সুতরাং এটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, প্রাচীনকালে এসবের সাহায্যে এবং ক্রোমাটোগ্রাফির বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে ওষুধের শোধন করা হত। এতে প্রমাণ হয় যে, প্রাচীনকালে আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি আজকের তথাকথিত বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের উৎকর্ষতায় মোটেও পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু এত উন্নত ও সফল চিকিৎসা পদ্ধতি তার শ্রেষ্ঠত্ব হারালো কেন!
এর যথাযথ উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে হবে। ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদ চিকিৎসা, যা তখন একমাত্র প্রচলিত চিকিৎসা ছিল, তার সুনাম দ্বাদশ শতাব্দী পযর্ন্ত অমলিন ছিল। কিন্তু তারপর, যবন আক্রমণের সময় থেকে এদেশের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও শিল্প সম্বৃদ্ধির অবক্ষয় শুরু হয়েছিল। যবন আগ্রাসনের সময় থেকে তাদের সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক প্রভাব চিকিৎসাবিদ্যার উপরেও আঘাত হানল। নতুন যবন শাসককুল আয়ুর্বেদের পৃষ্ঠপোষকতা দুরস্ত, তার ধ্বংসসাধনে ব্রতী হল। তারা আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বদলে ইউনানি চিকিৎসায় বিশ্বাস করত। তারা নিজেদের কথাই ভাবত। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনার কথা জানা যায়না। এই সময় বিস্তর দুর্মূল্য পুঁথি ও নথি নষ্ট করে ফেলা হয়। আমার মনে হয়, ঐ সময়ই আয়ুর্বেদ চিকিৎসার নথি – বিশেষতঃ শোধনক্রিয়ার বিভিন্ন কলাকৌশল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর ইরেজ বণিকের দল দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর তাদেরও দেশীয় চিকিৎসাশাস্ত্রকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার কোন চেষ্টা ছিলনা। তার কারণ তাদের উন্নাসিকতা। তারা তাদের শিক্ষা থেকে চিকিৎসা – সব ক্ষেত্রেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে থাকত।
দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং তারপরে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আয়ুর্বেদশাস্ত্র নিয়ে বিদেশে চর্চা শুরু হলে তখন আমাদের দেশের সরকারের টনক নড়ে। আবার সেখানেও গন্ডগোল। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টাকার বাণিজ্য করে ওষুধ-শিল্প। সুতরাং নথির ভিত্তিতে আয়ুর্বেদকে মান্যতা দিতে বাধ্য হলেও পাশ্চাত্য-দুনিয়া তার ওষুধ শিল্পকে মান্যতা দেয়না। তাদের অস্ত্র হল ঐ isolation and purification অর্থাৎ শোধন। আয়ুর্বেদ ওষুধের এই অপূর্ণতাকে আশ্রয় করেই পাশ্চাত্যের ওষুধশিল্প তাদের লাভের ব্যবসায় আয়ুর্বেদকে প্রবেশাধিকার দিচ্ছেনা। এ ব্যপারে অগ্রণী হল ওষুধ শিল্পের আন্তর্জাতিক কন্ট্রোলার আমেরিকার FDA. এই FDAর বিরুদ্ধে একাধিকবার সফল লড়াইয়ের ইতিহাস আছে একমাত্র জাপানের। সেজন্য FDA শুধু তাদেরকেই সমীহ করে।
এখন, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে আমাদের সরকারের উচিৎ এ বিষয়ে যথাযথ নজর দেওয়া আয়ুর্বেদ রিসার্চ ও শোধনে সাম্প্রতিকতম পদ্ধতি অবলম্বন করা, আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে drug efficacy পরীক্ষা করা এবং তার অনুমোদন ও বাজারে আনা – এই পুরো প্রক্রিয়ায় সরকারকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক ডাক্তারীশাস্ত্রে এই আয়ুর্বেদীয় ওষুধের সংযোজন এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে এর গুণাগুণ পরীক্ষা করে তা যে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের সমতুল বা উৎকৃষ্টতর তার প্রমাণ রাখার জন্য যথার্থ পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করার প্রয়োজন। তারপর কুটনৈতিকভাবে সরকারকে FDAর উপর চাপ তৈরী করতে হবে এই ভারতীয় পেটেন্টের আয়ুর্বেদীয় ওষুধকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। আর হ্যাঁ, সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিদেশের দালাল ও অর্ধশিক্ষিত ‘বিশেষজ্ঞ’দের থেকে দূরে থেকে এই মিশনকে সাফল্যমন্ডিত করতে হবে। দেশ এ কাজে সফল হলে বিশ্বের দরবারে ভারত আবার চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে “শ্রেষ্ঠ আসন লবে”।
( লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং পশ্চিমবঙ্গ জৈবপ্রযুক্তি উন্নয়ণ নিগমের প্রাক্তণ নির্দেশক ও পরামর্শদাতা)