ভারতীয় গণতন্ত্র সোনার পাথরবাটি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘গণতন্ত্র’ এমন একটি কথা যার অসংখ‍্য সংজ্ঞার মধ‍্যে কোন বিশেষ একটি সর্বজনগ্রাহ‍্য সংজ্ঞা পাওয়া যাবে না। এ যুগের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশী শোনা যায় ‘গণতন্ত্র’ আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এই দুটি কথা। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নিয়ে আগে একাধিক লেখায় আলোচনা করেছি যে, কোরান ও বাইবেল মোতাবেক ধর্মনিরপেক্ষতা মোটেই ভালোকথা নয়। কোন ধর্মপ্রান মুসলমান বা খ্রীষ্টান কখনো ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ হতে পারেন না। অথচ আমাদের দেশে প্রায় সমস্ত ইসলামী ও খ্রীষ্টান রাজনীতিক নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ বলেন এবং তা প্রমাণ করার জন‍্য প্রণান্তকর প্রচেষ্টা চালান। এখানেই আমাদের রাজ‍্যের তথা দেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট‍্য! ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের ট্রেণিংয়ের গোড়ার কথা – “যা ভাববে তা বলবেনা, যা বলবে তা করবেনা, যা করবে তা বলবেনা আর কাউকে কোন অবস্থায় না বলবেনা” – এটি জানিনা ফরেন সার্ভিসে কতটা প্রযোজ‍্য, তবে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে শতকরা একশ ভাগ প্রযোজ‍্য।
ভারতীয় গণতন্ত্র তার সংবিধান অনুসারে চলার কথা। আবার আমাদের সংবিধানের অবস্থা বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বাউলদের পোষাকের মত – তালিতাপ্পার মহিমায় আহল পোষাকের রূপ ও গুণের কিছুই আর বোঝা যায় না। তেমনি সংশোধনের পর সংশোধনে আমাদের সংবিধানের আসল চেহারাটাই হারিয়ে গেছে। তবু সব রাজনৈতিক নেতাই এদেশের গণতন্ত্র নিয়ে বড়াই করে। এমনকি সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশীয় কম‍্যুনিষ্টরা পর্যন্ত গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে উঠেছে! অবশ‍্য এ বিষয়ে তাদের অনেকের ‘আদর্শগত পিতা’ চীনের একনায়ক জি জিনপিংও সম্প্রতি চীনকে জনগণের গণতন্ত্রের (people’s democracy) দেশ বলেছেন। এখন এই গণতন্ত্রের রাজনীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, রাজতন্ত্র থেকে পরিবারতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র থেকে পলিটব‍্যুরোর কন্ট্রোলে থাকা রাষ্ট্র – এমনকি জেহাদী তালিবানরাও তাদের নিজেদেরকে ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবী করছে!
এবার এসবের কারন বিশ্লেষণ করা যাক। গণতন্ত্রের বিদ্রুপাত্মক সংজ্ঞা ছাড়া আর যত রকম সংজ্ঞা আছে, তার সবকটিতেই শাসন ক্ষমতায় মানুষের অংশগ্রহণের কথা বলা আছে। যেহেতু একটি দেশের সকল মানুষের পক্ষে দেশের শাসনব‍্যবস্থায় সরাসরি অংশ নেওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু তারা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটদান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন এবং সেই প্রতিনিধিরা তাদের হয়ে সরাসরি দেশের শাসনব‍্যবস্থায় অংশ নেবেন। এখানেই লুকিয়ে আছে অশান্তি, অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী স্বার্থে ‘ভোটদান’ প্রক্রিয়াকে কলুষিত করার বীজ। এভাবে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে বজায় রেখে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন চালানোই এখন আধুনিক গণতন্ত্র।
গণতন্ত্রে পরিষ্কারভাবে minority representation এর কথা বলা থাকলেও আমাদের দেশে তার কোন প্রয়োগ নেই – সব মানুষের
পছন্দকে মাণ‍্যতা দেওয়ার পদ্ধতি গণতন্ত্রের অঙ্গ। কিন্তু আমাদের দেশে ভোটের ময়দানে কেউ ৫০.১% ভোট পেলেই বিজয়ী হয়; অন‍্য কেউ ৪৯.৯% ভোট পেলেও পরাজিত। আবার ভোটে অনেক প্রার্থী থাকলে কেউ ২০ – ৩০% মাত্র ভোট পেলেও বিজয়ী হতে পারে। ফলে, দেশের মানুষের ভোটের সঠিক ও গণতান্ত্রিক মূল‍্যায়ণ হয় না। এর ফলশ্রুতিতে আমরা ভোট জালিয়াতির বিভিন্ন পদ্ধতি দেখি এবং জনগণের ইচ্ছার সঠিক মূল‍্যায়নকে কায়েমী স্বার্থে পরিবর্তিত হতে দেখি। একাজের জন‍্য রাজনৈতিক দলগুলিতে আলাদা মেশিনারী তৈরী হয়েছে। corruption begets corruption। আর কম‍্যুনিষ্টরা ‘ভোটযুদ্ধ’ জেতার জন‍্য তাদের মেশিনারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ময়দানে নামিয়ে দেয়!
প্রথম দফার ভোট জালিয়াতি শুরু – ভোটার লিস্টে নাম বাদ দেওয়া ও নাম তোলায়। আমাদের দেশে মানুষের পরিচয়পত্র, এমনকি ব‍্যঙ্ক ও অন‍্যান‍্য অনেক ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিযুক্ত আধার কার্ড একমাত্র প্রামাণ‍্য পরিচয়পত্র হলেও ভোটদানের ক্ষেত্রে ভোটার কার্ড হলেই চলবে! এই কার্ডের সঙ্গে বায়োমেট্রি না থাকায় যে কেউ এই কার্ড বানিয়ে ( নকল মানুষের আসল ভোটার কার্ড হতেই পারে) ভোট দিতে পারে। বিদেশী নাগরিকদের ক্ষেত্রেও এভাবে ভোটার হওয়ার সুযোগ থাকে। এমনকি আমাদের দেশের মানুষেরও একাধিক ঠিকানায় একাধিক ভোটার কার্ড থাকতে পারে। এছাড়া অনেক আসল ভোটারের নাম বাদ দেওয়া হয় মৃত বা লেফ্ট দেখিয়ে। এক্ষেত্রে ভোটের কাজে নিয়োজিত সরকারী প্রশাসনকে শাসকদল কাজে লাগায়। এর পরের পর্যায়ে ভোটের দিনের প্রাক্কালে সন্দেহজনক ভোটার যে শাসকের পক্ষে ভোট দেবেনা এমন মানুষদের উপর বিভিন্ন উপায়ে চাপ সৃষ্টি ও ভয় দেখানো শুরু হয়। একাজে শুধু রাজনৈতিক দলের ভোট মেশিনারীই নয়, বড় ভূমিকাসহ সহযোগীতা থাকে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারী প্রশাসন এভাবে কেন দলীয় স্বার্থে নিজেদের ব‍্যবহৃত হতে দেবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে এখনকার রাজনৈতিক সিস্টেমের দিকে তাকাতে হবে।
সেই সিস্টেম সম্পর্কে অল্প কথায় বলা যাক। এটি হল এই মূহুর্তে সারা পৃথিবীতে এবং ভারতের বি‍ভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আদৃত ‘পপুলিজম থিওরী’। এই তত্ত্ব অনুসরণ করে একাধিক রাজনৈতিক দল ভারতের রাজ‍্যে রাজ‍্যে ক্ষমতা দখল করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লী। মানুষ যা চায় তার সব, এমনকি তার চেয়ে আরো বেশী পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথমে ক্ষমতায় এসো। তারপর ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিকে একেএকে ধ্বংস কর। এর জন‍্য যাদের সাহায‍্য প্রয়োজন যেমন, সংবাদমাধ্যম ও প্রশাসন, বিশেষতঃ পুলিশ প্রশাসন – তাদের ‘পুরষ্কার ও তিরস্কার’ নীতির প্রয়োগে উপঢৌকন ও পদাঘাত করে নিজের দলের তাঁবে করে ফেল। ভারতকে যদিও গণতান্ত্রিক দেশ হলা হয়, এখানে মানুষ রাজারাজড়া ও অভিজাতশ্রেণীর প্রজা হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। তাদের পছন্দ benevolent dictatorship। দেশের রাজন‍্যবর্গের থেকে দেশটাকে ধীরে ধীরে ইংরেজরা ছিনিয়ে নিলেও তারা এদেশের মানুষদের ভালোই চিনেছিল। সে কারনে দেশের বহু জায়গায় তারা রাজন‍্যবর্গের প্রতীকী শাসন বজায় রেখেছিল। ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্খা দানা বেঁধেছিল এক অনন‍্যসাধারণ ব‍্যক্তিত্বকে অতিমানবের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে দেশের সুপ্রিম নেতৃত্বে বসিয়ে। হ‍্যাঁ, গান্ধীজীর কথাই বলছি। তিনি কংগ্রেস দলের কোন পদাধিকারী না হয়েও এবং আভ‍্যন্তরীন গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেও ছিলেন সর্বোচ্চ নেতা! একেই সুচতুরভাবে ব‍্যবহার করে জওহরলাল নেহরু দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তাঁর পারিবারিক শাসনব‍্যবস্থার বীজ রোপন করেন – যা পরবর্তীকালে মহীরুহ হয়ে কংগ্রেস নামক দলটাই তাঁর উত্তরপুরুষদের ব‍্যক্তিগত মালিকানায় চলে গেল। এর জন‍্য সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে (জওহরলাল কন‍্যা ইন্দিরা গান্ধী) অতিমানবের স্তরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা প্রশাসনিক ও সংবাদমাধ্যমগুলির সহযোগীতায় আলাদা মাত্রা পেল। এর সঙ্গে প্রয়োগ শুরু হল পপুলিজম তত্ত্বের। জনগণের গণতন্ত্র সম্বন্ধে নূন‍্যতম জ্ঞান নেইধরে নিয়ে তাদের গণতন্ত্রের নামে খুশী রাখার জন‍্য অর্থ, খাদ‍্য ইত‍্যাদির সঙ্গে আমোদপ্রমোদের জোগান দেওয়া শুরু হল। জনপ্রিয় শ্লোগান ‘গরীবি হটাও’ দিয়ে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার কাজ এগিয়ে গেল।
এই নীতি যেসব দেশ গ্রহন করেছে তারা ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেছে। স্বল্প পরিসরে ভেনেজুয়েলার উদাহরণ আদর্শ হতে পারে। এক সময় প্রাকৃতিক সম্পদে সম্বৃদ্ধ এই দেশ দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে ধনী দেশ হিসেবে নিজেদের মেলে ধরেছিল। ১৯৯৯ সালে কম‍্যুনিষ্ট নেতা হুগো স‍্যাভেজ ভেনেজুয়েলার শাসনভার দখল করে দেশের মানুষকে ভর্তুকিযুক্ত খাবার ও অন‍্যান‍্য নিত‍্যপ্রয়োজনীয় অনেক জিনিষ দিয়ে জনগণের মনে পপুলিজম তত্ত্বের উপর বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করলেন। এরজন‍্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারী অর্থভান্ডার থেকে দেওয়ায় আর্থিক ঘাটতি বেড়ে গল। যার ফলে দেশের উন্নয়ণ ও বিকাশের কাজ ব‍্যহত হতে শুরু করল। ষ‍্যাভেজের মৃত‍্যুর পর ২০১৩ সালে তাঁর শিষ‍্য নিকোলাস মাদুরো দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দিয়ে মানুষের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই ফ্রি করে দিলেন। ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ত বটেই, এমনকি সব রকম উন্নয়ণ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, উৎপাদন শিল্প – সব বন্ধ হয়ে গেল। দেশের আমদানীর পরিমাণ রেকর্ড বৃদ্ধি পেল।ফলে সরকারের রোজগার দ্রুত কমতে লাখল। এক সময় এমন অবস্থা হল যে ভর্তুকিতেও মানুষের নিত‍্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ কেনার ক্ষমতা রইল না। দেশের আশি শতাংশ মানুষ দরিদ্রতম বলে চিহ্নিত হল। কর্মসংস্থান বন্ধ হল। দেশে অতি উচ্চহারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটল। জনগণের বিক্ষোভ শুরু হল। সেই বিক্ষোভ দমনে গুলি চালানো, মৃত‍্যু – সব ঘটল। এমতাবস্থায় ২০১৯ সালে জুয়ান গুয়ায়িদো সংযুক্ত বিরোধীদের প্রার্থী হিসেবে নিজেকে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করলেন! এখানে উল্লেখ‍্য যে ২০¹৮ সালে সেদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার জন‍্য মাদুরো সব রকমের পকৌশল ও দূর্ণীতির আশ্রয় নেওয়ায় বিরোধীরা সেই নির্বাচন অবৈধ বলে। পাশ্চাত‍্য দুনিয়া এবং পৃথিবীর বহু গণতান্ত্রিক দেশ তাদের সমর্থন করে। এবং পরবর্তীতে তারা গুয়ায়িদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাণ‍্যতা দেয়। কিন্তু সেনাবাহিনীর সাহায‍্য নিয়ে মাদুরো দেশের মধ‍্যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন। এভাবে এক দেশে দুই প্রেসিডেন্ট! মাদুরো এই বিধ্বস্ত অর্থনীতির মধ‍্যে যুক্তিহীন ও অনৈতিকভাবে দেশের সেনাবাহিনীর বেতন ও সুখসুবিধা বাড়িয়ে চলেছেন।
এই উদাহরণ দেওয়া উদ্দেশ‍্য হল, আমাদের দেশে বেশকিছু রাজ‍্যের মানুষকে এই রকম পপুলিজম তত্ত্ব মোতাবেক অনুদান দেওয়ার প্রভূত প্রকল্প দেখতে পাই। দুয়ের সমন্নয় লক্ষ‍্যণীয়। পশ্চিমবঙ্গে মাদুরো নীতির প্রয়োগ চলছে বললে অত‍্যুক্তি করা হয়না।
আমাদের দেশে এর জন‍্য সমস‍্যা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের কথায় এলে বলতে হয়যে, ষাটের দশকের পর থেকে এই রাজ‍্যে যেমন শিল্পের বিকাশ হয়নি তেমনই জঙ্গী কম‍্যুনিষ্ট আন্দোলন ও তার উত্বরকালে কম‍্যুনিষ্ট শাসনে এই রাজ‍্যে কলকারখানা স্থাপন ত দূরঅস্ত, একের পর এক চালু কারখানা বন্ধ হয়েছে। এরাজ‍্যের শিল্পে ‘ঘেরাও’ কথাটি এত চালু হয়েছিল যে তা অক্সফোর্ড ডিক্সনারিতেও স্থান পেয়েছে! সরকারী বেতন কাঠামোয় প্রচুর স্থানীয় প্রশাসন ও সরকার পোষিত সংস্থায় অত‍্যধিক বেতনবৃদ্ধি, সঙ্গে নিয়মিত ডিএ বাড়ানো ইত‍্যাদি কারনে সরকারের কোষাগারে চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেতনের টাকা মেটাতে ওভার-ড্রাফ্ট নেওয়া শুরু হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ণ না করে এই অনুদান নীতি যখন আর চলছিলনা তখন বড় শিল্প স্থাপনের চেষ্টা করতে গিয়ে সেই সরকারের পতন হল। আরো বেশী অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বর্তমান শাসকদল রাজ‍্যসরকারে ক্ষমতায় এলো। হুগো স‍্যাভেজের কায়দায় বিরোধী উৎখাত, প্রশাসন, সংবাদমাধ্যম ও পুলিশ প্রশাসন – সব কিছুই পার্টি তথা ব‍্যক্তি নিয়ন্ত্রনে এসে যাওয়ায় এবার সুষ্ঠুভাবে প্রশাসন চালানোর প্রশ্ন এলো। “অনুপ্রাণিত” প্রশাসন তার স্বচ্ছতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে হিরিয়েছে তার দক্ষতাও। তখন ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী larger than life নেতা (নেত্রী) বানানো হল! সব সমষ‍্যার সমাধান করে বিভিন্ন নামে ভোটারদের অনুদান দেওয়া শুরু হল। এছাড়া অবশ‍্য শাসকের আর কিছু করার ছিল না। তাই ভেনেজুয়েলার নির্বাচনের মত এখানেও এখানেও নির্বাচনী গণতন্ত্রের মূল কথা – সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত – এই তিনটিই নির্বাচনের সময় অবলুপ্ত হয়ে গেল।
আমরাশুধু এ রাজ‍্যে নয়, অন‍্যান‍্য রাজ‍্য, এমনকি কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও এই রাজ‍্যের প্রভাব অনুভব করছি। জওহরলালের পর যখন ইন্দিরা দেশের শাসনভার ‘দখল’ করেছিলেন এবং সেইসঙ্গে গণতন্ত্রের মোড়কে পরিবারতন্ত্র কায়েম করতে সচেষ্ট হন, তখন থেকেই আবার দেশের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে larger than life বানানোর চেষ্টা শুরু হয় – যা এখনো চলছে। কুশীলব বদলাচ্ছে – নীতি নয়! এই সময়ে এসে দেশের মানুষের স্বভাব পরিবর্তনের একটি দিক নিয়ে আলোকপাত করে এই লেখা শেষ করব। বর্তমানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নবম মূখ‍্যমন্ত্রী হচ্ছেন শ্রীমতি মমতা মূখোপাধ‍্যায়। এর আগের কোন মূখ‍্যমন্ত্রী সম্পর্কে রাজ‍্যের মানুষ তথা মন্ত্রী সান্ত্রীদের ‘মাননীয়’ সম্বোধন করতে শুনিনি। কিন্তু এখন মনে হয়, কোন অলিখিত নীতির প্রয়োগে এটা বলা বাধ‍্যতামূলক! আবার জনসাধারনের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন জনগণের টাকায় কোন প্রকল্প উদ্বোধন বা শুরু করেন, তখন “মাননীয়া” ও “অনুপ্রেঢ়নায়” – কথাদুটি অত‍্যন্ত শ্রুতিকটুভাবে কানে বাজে। এতে কি মূখ‍্যমন্ত্রীর সম্মান বাড়ে? মনেহয়, অশিক্ষাজনিত চাটুকারীতার উজ্জ্বল নিদর্শন এই ধরনের চামচাবাজি। সত‍্যি কথা বলতে কি, কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক লঘুভার মন্ত্রী ও আধামন্ত্রী (MOS) কেও আমরা বারবার “মান‍্য নরেন্দ্রমোদীজী” বলতে শুনি আর কেন্দ্রীয় সব প্রকল্পই যেন তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় সাধিত হয়! এভাবেই ইমেজ বিল্ডিং হয় ও গণতন্ত্রের গঙ্গাজলী যাত্রার দিকে দেশ এগিয়ে চলে।
গণতন্ত্রকে রক্ষা কযার জন‍্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন ভোটারদের যথার্থ শিক্ষিত করা। একাজ করতে কায়েমী স্বার্থের কারনে রাজনীতিকরা সর্বতোভাবে বাধা দেবে। ভোটারদের নিজেদের অভিজ্ঞতা মাধ‍্যমে বুঝতে হবে, অর্থ ও খাদ‍্যের বিনিময়ে যারা আমাদের ভোট কিনছে তারা আজকের জন‍্য সাময়িক সংস্থান করলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের আগামী সংস্থানকে ধ্বংস করছে। এই শিক্ষা না থাকলে তার গণতন্ত্রে ভোটাধিকার থাকা উচিৎ নয়। এছাড়া, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনের জন‍্য সমাজ যদি তৈরী না হয়, তাহলে আমাদের দেশে কোথাও মুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সফল হবেনা। পক্ষান্তরে, উপমহাদেশের পরিস্থিতি মাথায় রেখে বলা যেতে পারে, ভবিষ‍্যতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা দুষ্কর হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *