ভারত টীকাকরনে সাফল‍্যের শিখরে

পৃথিবীর দ্রুততম জনসংখ্যা বৃদ্ধির দেশ আমাদের ভারত। একশ ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কোটি মানুষের দেশে কোভিডের টীকাকরন চালানো যে কতটা দুরূহ তা WHOর প্রতিবেদনেও পরিষ্কার। নভেম্বর, ২০২১এর শুরুতে, এখনো পর্যন্ত সরকারী পরিসংখ‍্যান অনুযায়ী দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ‍্যে ত্রিশ কোটি মানুষের টীকাকরনের দুটি ডোজ হয়ে গিয়েছে। তাঁরা টীকাকরন সমাপ্ত হওয়ার শংসাপত্র পযর্ন্ত পেয়ে গিয়েছেন। এই সংখ‍্যাটি মোট টীকাকরনযোগ‍্য মানুষের ৩০%। এছাড়া দেশের সত্তরকোটি মানুষ টীকাকরন প্রক্রিয়ার মধ‍্যে আছেন। অর্থাৎ তাঁদের দুটি ডোজের প্রথম ডোজ পাওয়া হয়ে গেছে; এখন দ্বিতীয় ডোজের প্রতিক্ষায়। তাহলে আগামী নব্বই দিনের মধ‍্যে এদের সবার পূর্ণ টীকাকরন হয়ে যাবে। অর্থাৎ, শুধু যে একশকোটি মানুষের টীকাকরন হয়ে গেছে তাই নয় – আগামী জানুয়ারী মাসের মধ‍্যে দেশের ৭০% মানুষের টীকাকরন সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এতে সময় লাগছে এক বছরের কাছাকাছি। অনেক তথাকথিত ‘বোদ্ধা’ বলেছিলেন যে ভারতে নাকি আগামী দশ বছরেও টীকাকরনের লক্ষ‍্যমাত্রা পূরণ করা যাবে না! প্রশাসনিক তৎপরতা, বিশেষতঃ আমাদের ভারতীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও কঠোর তত্ত্বাবধানে এই কাজ করার জন‍্য সরকারকে অসংখ‍্য ধন‍্যবাদ। রাজনীতি বাদ দিয়ে, WHO কিন্তু ভারতে টীকাকরন কর্মসূচীর ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
ভারতের মত বিশাল, বিভিন্ন ভাষা-ভাষী, ঐতিহ্য ও রাজনীতি সচেতন দেশে টীকাকরনের ক্ষেত্রে অসংখ‍্য বাধা আসার কথা – আর অবধারিতভাবে তা এসেছেও। আমাদের দেশের বিরোধী রাজনীতি – বিশেষতঃ ইন্দিরা-উত্তর জমানায় – ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়েছে। কান্ডজ্ঞানহীণ বিরোধীতায় সর্বদা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টীকাকরন তার ব‍্যতিক্রম নয়। টীকাকরনে সরকারী প্রচেষ্টাকে সহায়তা করার বদলে অনেক রাজনৈতিক নেতা টীকাকরনের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন করতে শুরু করেন! টীকাকরন কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি উল্লেখযোগ্য স্তর। কখনো কেউ বলেনি যে টীকাকরন হলেই আর কোভিড সংক্রমণ হবেনা। এই নিয়ে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির অপচেষ্টাকে রুখতে অযথা শক্তিব‍্যয় হয়েছে। এরপর আছে টীকাকরনের বিপুল খরচ। ইউরোপ, আমেরিকায়, এমনকি এশিয়ার উন্নত দেশগুলির কোথাও নিখরচায় টীকা দেওয়া হয়নি। হ‍্যাঁ, অনেকক্ষেত্রেই সরকারী ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে শুধুযে ভর্তুকিতে টীকাকরন প্রক্রিয়ার বিপুল কর্মযজ্ঞ সাধিত হচ্ছে তাই নয়, দেশের বিপুল সংখ‍্যক জনগণের এক বড় অংশকে নিখরচায় টীকা দেওয়া হচ্ছে। এই বিপুল ব‍্যয়ভার দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে বাধ‍্য। সরকারকে ধন‍্যবাদ যে, সরকার সেই ব‍্যয়ভার বহন করছে। পৃথিবীতে আর একটিও এমন দেশ নেই যেখানে এত বিশাল সংখ‍্যার মানুষকে সম্পূর্ণ বিনামূল‍্যে টীকা দেওয়া হয়েছে – কোন কম‍্যুনিষ্ট দেশ ত নয়ই! এটা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, ভারত কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়নামারের মত ফ্রিতে বিদেশ থেকে টীকা উপহার পায়নি। ভারতে ব‍্যবহৃত টীকা আমাদের দেশের দুটি কোম্পানি তৈরী করেছে। এই টীকা বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে তারা আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডারকে স্ফীত করেছে। ভারতের দুটি টীকাই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
রাজনৈতিক বিরোধীতার নামে যারা ভারত বিরোধীতায় মেতে উঠে চীনের টীকাকরনের প্রসঙ্গ তুলে সরকারের বিরোধীতা করে, তাদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি তথ‍্য জানানো যাক। পাঁচটি চীনা টীকা বাজারে আন্তর্জাতিক ছাড়পত্র পেয়েছে। সবচেয়ে বেশী ব‍্যবহৃত সরকারী মালিকানার কোম্পানি sinopharmএর coronavac। তাদের পাঁচটি টীকার কার্যকারিতা (efficacy) ৫০% থেকে ৭০% এর আশেপাশে। আমাদের ভারতের দুটি টীকাই তুলনায় অনেক বেশী কার্যকারিতার মাণ‍্যতা পেয়েছে। সেজন‍্য চীনের টীকার তুলনায় ভারতের টীকার রপ্তানির রেকর্ড ভালো। এমনকি রাশিয়ার টীকা স্পুটনিকের তুলনায় ভারতের দুটি টীকার কার্যকারিতাই অনেক ভালো। রাশিয়া কিন্তু তার সব নাগরিককে নিখরচায় টীকা দেয়নি। চীনের স্থানীয় প্রশাসনগুলি প্রথমে বিভিন্ন রকম পরিষেবার ফি নিয়ে টীকাকরন শুরু করেছিল। তারপর চীন সরকার পরবর্তী সময়ে এই টীকা বিনিমূল‍্যে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। তারা বিনামূল‍্যে সরকারী কোম্পানি sinopharmএর টীকা দিচ্ছে। ভারত বা অন‍্যান‍্য দেশে সরকারী মালিকানার সংস্থায় এই টীকা তৈরী হয়না। তাই অন‍্য কোন দেশ নিঃশুল্ক টীকাকরন করতে পারে না। চীনের এই টীকার গবেষণা, উৎপাদন ও পরিবহনের খরচ সরকার দিলেও কোভিড সেসের মাধ‍্যমে চীন এই অর্থ জনসাধারণের থেকেই তুলেছে। এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। বাংলাদেশ, বাহারিন ও UAE প্রথমে চীনা টীকা আমদানি করলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বব‍্যপী সন্দেহের বাতাবরন ও কর্মক্ষমতায় ঘাটতি থাকায় এই দেশগুলিও এখন ভারতীয়, আমেরিকান বা ইউরোপীয় টীকার দিকে ঝুঁকেছে। তুরষ্ক, ব্রাজিল ও চিলি প্রথমে বরাত দিলেও এখন আর চীনা টীকা আমদানী করছেনা। এর সবচেয়ে বড় কারন, চীনা টীকার গবেষনালব্ধ ফল প্রকাশের অস্বচ্ছতা ও তার কার্যকারিতা কম হওয়া।
এত সব সত্ত্বেও চীন এবং ভারত দুটি দেশই তার নাগরিকদের মধ‍্যে একশকোটিকে টীকাকরনের আওতায় এনেছে। এর মধ‍্যে ভারতের শতকরা হিসেবে ও টীকার কার্যকারিতায় আমরা অনেক এগিয়ে। একটা ছোট ঘটনার উল্লেখ করছি। পাকিস্তানকে চীন ও ভারত উভয় দেশই মানবিক কালনে তাদের নিজেদের দেশে প্রস্তুত টীকা পাঠায়। এর মধ‍্যে ভারতে প্রস্তুত টীকার পুরোটা পাকিস্তান ব‍্যবহার করলেও চীনের পাঠানো টীকার পুরো কোটা তারা ব‍্যবহার করেনি। রাজনীতি অন‍্য ব‍্যপার। কিন্তু এর থেকে এটা পরিস্কার যে টীকার বিশ্বাসযোগ‍্যতায় চীনা টীকাকে ভারতীয় টীকা ছাপিয়ে গেছে।
এবার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আসা যাক। যেহেতু আমাদের দেশের নাগরিকদের ৭০%এর টীকাকরন ২০২২ সালের প্রথমদিকেই সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, আমাদের মধ‍্যে herd immunity তৈরী শুরু হয়েছে। এটা অত‍্যন্ত খুশীর খবর। দেশের ক্রমহ্রসমান আক্রান্তের সংখ‍্যা এই তথ‍্যকেই সমর্থন করে।
এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার। চীন আমাদের দু মাস আগে টীকাকরন শুরু করেও ভারতের আগে এগিয়ে থাকতে পারেনি। এর কৃতিত্ব সাধারন নাগরিক, স্বাস্থ‍্যকর্মী, সরকারী প্রশাসন থেকে ধরে প্রশাসনিকস্তরের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনকারীদের উপর বর্তায়। রাছনৈতিক বিরোধীতা করার নামে টীকাকরনের বিরোধীতা কিন্তু দেশের মানুষের স্বাস্থ‍্য-সুরক্ষার বিরোধিতা করা। কারন, টীকাকরনের বিপুল কর্মযজ্ঞে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে স্থানীয় স্তর, সকলের ঐকান্তিক সহযোগীতাতেই এই সাফল‍্য এসেছে। পরিকল্পনা ও তার সফল রূপায়নের জন‍্য তাঁদের সকলের ধন‍্যবাদ প্রাপ‍্য।
অনেক রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের মন যুগিয়ে চলা সংবাদপত্র দাবী তুলেছিল যে সব নাগরিকদের বিনামূল‍্যে টীকা দিতে হবে! এ কিভাবে সম্ভব? সরকারকে টীকা কিনতে হচ্ছে। তারপর টীকাকরনের আনুষঙ্গিক খরচ, পরিবহনের খরচ – এইসব সরকারকেই দিতে হবে! এই টাকা সরকারের কাছে আসবে কোথা থেকে? যেজন‍্য কোন দেশই বিনামূল‍্যে সম্পূর্ণ টীকাকরন করতে পারেনি। কিন্তু ভারত সরকার ফেশ কিছু টীকা বিনামূল‍্যে দিয়েছে এবং যথারীতি সেই খরচের চাপ সরকারী কোষাগারের উপর পড়েছে। এটাই নিয়ম। চীনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তারা ‘মাছের তেলে মাছ ভাজা’র মত নীতিতে ‘বিনা পয়সায় টীকা’ দিয়েছে। তবুও বলব, আমাদের দেশে অত‍্যন্ত কম টাকায় টীকা দেওয়া হয়েছে। আমি প্রথম ডোজ ২৫০ টাকা ও দ্বিতীয় ডোজ ৭৮০ টাকার বিনিময়ে পেয়েছি। অথচ আমেরিকায় টীকার নূন‍্যতম মূল‍্য ৬ ডলার অর্থাৎ প্রায় ৪৮০ টাকা – সঙ্গে টীকা দেওয়ার খরচ। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার টাকা। আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের সঠিক পরিকল্পনার সুফল আমরা পেয়েছি। যে দুটি সংস্থা আমাদের দেশে টীকা তৈরী করছে – কোভিশিল্ড ও কোভ‍্যাকসিন – ভারত সরকার তাদের বিভিন্ন সুবিধে দিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে ভর্তুকিমূল‍্যে কিনে বিভিন্ন রাজ‍্যসরকারের মারফৎ সরবরাহ করায় এত সুলভ মূল‍্যে টীকা পাওয়া গেছে। আমাদের দেশের ছনসংখ‍্যার কথা মাথায় রেখে বলতে হয় যে এত বিপুল পরিমান ভর্তুকি আর কোন দেশকে দিতে হয়নি। এই সুবিশাল কর্মকান্ডের পরিকল্পনা ও তার সফল রূপায়ণ যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে।
পরিশেষে জানাই, এবাবে চললে আমরা দুবছরের (যা শুরুতে সংখ‍্যাতত্ত্বের বিচারে নূন‍্যতম মনে হয়েছিল) অনেক কম সময়ে আমাদের দেশের কোভিড টীকাকরন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *