পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের ঘোষণা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে সুবিধাপ্রাপ্ত বিজ্ঞজনেরা যথারীতি তাদের মালিকের পক্ষে এই প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে আকাশকুসুম বোঝাতে লেগেছে। এই প্রকল্পের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার আগে প্রকল্পটি কি, কেন আর কিভাবে বাস্তবায়িত হবে তার সম্পর্কে না জেনেই অনেকে খুশীতে গদগদ হচ্ছেন; আবার কেউ কেউ নিন্দায় পঞ্চমুখ হচ্ছেন! সবচেয়ে বড় কথা হল, এটি একটি রাজনৈতিক গিমিক যা অনুধাবনে বিরোধীরাও সক্ষম নয়।
একের পর এক এমন মনভোলানো পরিকল্পনা গত দশ বছরে রাজ্য সরকার চালু করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও এমন কিছু প্রকল্প এনেছে যাতে কাজের থেকে অকাজ বেশী হয়েছে। এমনই একটি স্কীম এই রাজ্য সরকারের নবতম স্টুডেন্টস ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প। এটি আদতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি অঙ্গীকার পত্র যা গেজেটে ৩০শে জুন,২০২১ এ প্রকাশিত হয় এবং পরদিন থেকেই কার্যকর হয়। এই প্রকল্পটি নিয়ে সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, এটি কিন্তু ব্যাঙ্ক কৃষককে টাকা ঋণ দিল আর কৃষক টাকা নিয়ে শোধ দিলনা – তখন সরকার ব্যাঙ্কের ঋণ মুকুব করে দিল – এমন নয়। এটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে একটি ঘোষণাপত্র যাতে বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে পশ্চিমবঙ্গে দশ বছর বা তার বেশীদিন ধরে বসবাসকারী ছাত্র-ছাত্রী বা তার অভিভাবক থাকলে তারা বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে প্লাস্টিক কার্ড যা আদতে ক্রেডিট কার্ড পাবে এবং এই কার্ডে শর্ত সাপেক্ষে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবে। এই ঋণ পনেরো বছর বা চাকরী পাওয়ার পর, যেটি আগে হবে, পরিশোধ করতে হবে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, বহু বছর আগে থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের স্টাডি লোনের ব্যবস্থা ব্যাঙ্কগুলি থেকে চালু আছে যা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়ম মেনে ব্যাঙ্কগুলি উৎসাহী ও যোগ্য ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে থাকে। সুতরাং এটি নতুন কিছু নয়। এখানে কয়েকটি চমক দেখানোর চেষ্টা হয়েছে মাত্র।
যে ব্যাঙ্কগুলি ক্রেডিট দেবে তাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদেশে ক্রেডিট দেওয়ার কথা নয়। তারা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশ ও গাইডলাইন মেনে চলে। এরা কেউই পশ্চিমবঙ্গের সরকারের অধীনস্ত নয়। এখানে রাজ্য সরকারের কোন ভূমিকা থাকার কথা নয়। রাজ্য সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কগুলির উপর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তীক্ষ্ণ নজর ও পর্যবেক্ষণ থাকার কারনে তারাও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গাইডলাইনের বাইরে কিছু করতে পারবে না। এদিকে রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকা অনুচ্চারিত! বিদেশে পড়ার ব্যপারেও এই ঋণ নাকি পাওয়া যাবে! তাতে কেন্দ্রীয় সরকার, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, ঋণগ্রহীতা ও ঋণ দেওয়া ব্যাঙ্কের ভূমিকা থাকে। এখানে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কি? সে ত গ্যারান্টারও নয়!
হ্যাঁ, এই ধরনের ক্রেডিট ঋণের সুদ ৬.৫-৭.৫% হওয়ায় এই ঋণগ্রহীতাদের সুদের ২.৫-৩.৫% রাজ্যসরকার দেবে এবং ঋণগ্রহীতাকে ৪% সুদ দিতে হবে। আর ৪ লাখ টাকার উপরে যে ৫% মার্জিন মানি দেওয়ার কথা,সেটি স্টাডি লোনের ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য। এমনকি ছাত্রদের নিজেদের খরচে ইন্সিওরেন্স অবধি এক। প্রায় পুরো প্রকল্পটিই চালু স্কীমকে টুকে দেওয়া। শুধু তফাতের জায়গাগুলি বলছি। প্রথমেই আসি, এধরনের লোনের ক্ষেত্রে ৬.৫-৭.৫% সুদের ব্যপারটায়। এখানে সরকার যে ২.৫-৩.৫% সুদ মেটাবে তার জন্য সরকারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক নিশ্চয়ই আলাদা চুক্তি করবে। শুনতে ভালো। কিন্তু ওর বাস্তবায়ন কতটা হবে! ঋণ দেওয়ার ব্যাঙ্কগুলি রাজ্য সরকারের অধীন নয় এবং তারা তাদের নিজেদের নিয়মে কোল্যাটারাল সিকিউরিটি চাইবে। কারন, ঋণ খেলাপের দায়িত্ব ঋণ দানকারী ব্যাঙ্কের অফিসারদের উপর বর্তায়। এদিকে রাজ্য সরকার গ্যরান্টার হলে যে বাস্তব অসুবিধাগুলো আছে সেগুলিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্য সরকার কিন্তু কোন ব্যক্তিবিশেষ বা কোম্পানি নয় যে তার সম্পদ সিকিউরিটি ডিপোজিট হিসাবে মর্টগেজ রাখবে। অর্থাৎ কোন ছাত্রের ঋণের কোল্যাটারাল সিকিউরিটি রাজ্য সরকার দিতে পারে না। আবার ব্যাঙ্কও এই ধরনের সিকিউরিটি নেবে না কারন তা কার্যকর করার তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। সুতরাং, রাজ্য সরকার যদি এই ঋণের কো-গ্যরান্টার (ছাত্র বা অভিভাবক গ্যরান্টার) হয় তাহলে, সম্পূর্ণ ঋণের সরকারের ভাগের সুদ মেটানোর বাৎসরিক সংস্থান রাজ্য সরকারের বাজেটে আলাদাভাবে থাকতে হবে। যতদূর জানি, আমাদের রাজ্য বাজেটে এ ধরনের সংস্থান আলাদাভাবে দেখানো হয়নি।
এরপর আরেক জায়গায় স্টাডি লোনের সঙ্গে এই প্রকল্পের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। কোন চাকরীর পরীক্ষা, যেমন IAS, IPS, WBCS, SSC ইত্যাদির ট্রেণিং নেওয়ার বেসরকারী ইন্সটিটিউটে ভর্তি হওয়ার জন্যও ঋণ মিলবে! ফি ছাড়াও থাকা-খাওয়া ও বইপত্র ইত্যাদি কেনার জন্য যথাক্রমে ২০% ও ৩০% ঋণ মিলবে! তারপর যদি সেই ছাত্র বা ছাত্রী পরীক্ষায় কৃতকার্য না হতে পারে তবে সে পনেরো বছরের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে কিভাবে ঋণ শোধ করবে? সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কি? তারা কি ঋণ পরিশোধ ও সুদের দায়িত্ব নেবে? যদি না নেয়, তবে কোন ভরসায় ব্যাঙ্ক এই ধরনের ঋণ দেবে? বিশেষতঃ যেখানে ঋণের কোন সিকিউরিটি নেই।
এবার শেষ তফাৎটির কথা বলি। শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, ক্লাশ টেন পাশ করার পরই কোন ছাত্র বা ছাত্রী এই ঋণের আবেদন করতে পারবে! অর্থাৎ হায়ার সেকেন্ডারী ক্লাসে পড়ার জন্যও এই ঋণ পাওয়া যাবে। কাজেই একে শুধু উচ্চশিক্ষার জন্য ঋণ বলা যাবেনা। এই ঋণ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড স্কীম নাম দিয়ে রাজ্য সরকার এমন একটি প্রকল্প ঘোষণা করে দিল যার উপর সরকারের কোন কার্যকরী কন্ট্রোলিং ভূমিকা নেই। এটা অনেকটা রাজ্যের মানুষের সুবিধার নাম দিয়ে ব্যাঙ্কের বিভিন্ন স্কীম ঘোষণা করার মত! সবচেয়ে বড় কথা, এই ক্রেডিট কার্ড রাজ্য সরকারের বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক নয়, ব্যাঙ্কগুলি একমাত্র রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমোদন সাপেক্ষে দিতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে রাজ্য সরকার বুদ্ধিমানের মত এমন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যেটা প্রায় ৯০ শতাংশ হচ্ছে বহু বছর ধরে চালু স্টাডি লোনের নামান্তর মাত্র। শুধু তফাৎগুলি এখানে আলাদাকরে উল্লেখ করা হল।
কি অদ্ভুত ছেলেভোলানো বিজ্ঞপ্তি! ক্রেডিট কার্ড দেবে ব্যাঙ্ক যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিয়মে চলে। ব্যাঙ্কের ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা, ঋণ প্রদানের নিজস্ব পদ্ধতি ও নিয়ম নীতি আছে। মানলাম, সেসব মেনেই ব্যাঙ্কগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের ঋণ দিল। এবার এই ঋণের পদ্ধতিগত রিলিজের কথা যা বিজ্ঞপ্তিতে বলা আছে, তার সঙ্গে কিন্তু প্রচলিত স্টাডি লোনের কোন তফাৎ নেই।
এবার আসি এই সরকারী আদেশনামার অসারতার বিষয়ে। এখানে দশ ক্লাশ পাশ করার পর কোন ছাত্র এগারো ক্লাশে ভর্তি হয়ে ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তির পরীক্ষার প্রাইভেট কোচিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি হলেও তার ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা হবে! তারপর সেই ছাত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে তার ঋণ মেটানোর ক্ষমতা না থাকায় রাজ্য দেওয়ার কি সেই দায়িত্ব নেবে? মনে হয়না। দ্বিতীয় একটি বিষয় হল, ছাত্রদের ঋণের টাকা সুদসমেত ফেরৎ দেওয়ার দায়িত্ব – এই ধরনের গ্রুমিং না থাকার কারনে অনাদায়ী ঋণ বাড়ার আশঙ্কায় কোন ব্যাঙ্ক এই ঋণ দিতে আগ্রহী হবেনা। আবার HOIদের উপর ছাত্রদের ঋণ পাওয়ার প্রাথমিক কাগজপত্র পরীক্ষা করে সরকারের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করার দায়িত্ব থাকায় তাঁরা অসুবিধায় পরবেন। কারন বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক চাকরীর পরীক্ষা ও বৃত্তিগত কোর্সে ভর্তির ট্রেনিং ইন্সটিটিউটগুলির স্থায়ীত্ব ও স্বচ্ছতা কিভাবে HOIরা বিচার করে সন্তুষ্ট হবে! কারন ছাত্র-ছাত্রীরা প্রথমে তাদের Head of the Institutionএর কাছে কাগজপত্র যেমন আধার কার্ড, দশ বছর রাজ্যে থাকার রেকর্ড ও যেখানে ভর্তি হবে তার অফার লেটার, ফি স্ট্রাকচার সব জমা দেবে। HOI সেগুলি সঠিক থাকল (?) তা উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করবে (যদিও উচ্চমাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা দপ্তরের অধীন নয়)। তারপর ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন করতে হবে! ব্যাঙ্ক সন্তুষ্ট হলে তবেই ঋণ পাওয়া যাবে। যেহেতু ব্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে নয়, তারা তাদের ঋণ ফেরতের নিশ্চয়তা চাইবে। রাজ্য সরকার সেই নিশ্চয়তা দিলে তার জন্য তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণের বাজেট allocation রাখতে হবে। এই বিজ্ঞপ্তি বেরোনোর পর বাজেট পেশ হলেও এমন কোন allocation নেই এবং তা কোন provision ও নেই।
তাহলে নিট ফল কি দাঁড়ালো? প্রথমতঃ HOIএর উপর চাপ বাড়ানো হল, তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সেলিং করতে বলা হল যাতে তারা বেশী সংখ্যায় আবেদন করে। ছাত্ররা যদি তাদের আবেদনের কাগজপত্র ঠিকমত আপলোড করতে না পারে তবে বদনাম হবে HOIদের! আবার যদি ঋণের আবেদনের বৃহদাংশ ঋণের সিকিউরিটির অভাবে এবং অস্বচ্ছতার কারণে বাতিল হয় ত বদনাম হবে ব্যাঙ্কের! তখন শাসকদল তার রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে পারবে। তারা প্রচার করবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ব্যাঙ্কগুলি পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার ঋণ দিচ্ছেনা – যদিও রাজ্য সরকার তাদের আর্থিক দায়িত্ব নিতে রাজী(!)।
সুতরাং রাজ্য সরকার এমন একটি প্রকল্প আনলো যাতে তার সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ল, আবার সেইসঙ্গে এইধরনের ঋণ বিশেষ মঞ্জুর না হওয়ায় সরকারের উপর সুদের আর্থিক চাপও বাড়লনা। এটি একটি সূক্ষ্ম রাজনৈতিক চাল যা অন্য অনেক তথাকথিত প্রকল্পের মত মুখ থুবড়ে পরবে আবার রাজ্যের শাসক দলকে রাজনৈতিক ডিভিডেন্ডও দেবে।
রাজ্য সরকারের স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড একটি রাজনৈতিক চাল
