লালন শেখের মৃত‍্যু ও কিছু প্রশ্ন

সংবাদের শিরোনামে বগটুই গ্রামের উঠে আসার কারন ছিল ঐ গ্রামের মহিলা ও শিশুসহ গত ২১শে মার্চ ১০ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার খবর। স্থানীয় বাহুবলী টিএমসি নেতা ভাদু শেখের মৃত‍্যুর বদলা নিতে এই হত‍্যাকান্ড বলে অভিযোগ। ঘটনার বেশ কিছুদিন পর যখন এই হত‍্যাকান্ডের তদন্তভার উচ্চ আদালতের নির্দেশে CBIএর হাতে গেল, তখন থেকেই টিএমসি ও তাদের সরকারের লোকজন খোলাখুলিভাবে CBI তদন্তভার নেওয়ায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। এখানে একটি কথা বলা দরকার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই রাজ‍্যে শাসকদল টিএমসির অভিযুক্ত লোকজনদ্বারা খুন,জখম, ভীতি প্রদর্শন ও মারধোরের ঘটনার পুলিশী তদন্তের পর ১% অভিযুক্তেরও শাস্তি হয় না! স্বাভাবিকভাবেই টিএমসি বলে থাকে সব “সাজানো ঘটনা”! গত কয়েকটি নির্বাচনের সময় ও নির্বাচন পরবর্তী হিংসার ঘটনায় যত মায়ের কোল খালি হয়েছে, তার ১% এর ক্ষেত্রেও অভিযুক্তর কোন শাস্তি হয়নি – তা তদন্ত CBI বা রাজ‍্যের “দলদাস” পুলিশ – যেই করুক না কেন! ফলত, রাজ‍্যে দুষ্কৃতিদের দাপাদাপি বৃদ্ধিতে প্রশাসনিক অপদার্থতা বা নিস্পৃহতা যে অনেকাংশে দায়ী, তা বলাই বাহুল‍্য।
যাক, ফিরে আসি বগটুই প্রসঙ্গে। CBI ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা এই হত‍্যাকান্ডের মূল অভিযুক্ত লালন শেখকে গ্রেপ্তার করে। এই গ্রেপ্তারে ওই ১০ জন মৃতের পরিবার খুশী হয়, তারা অভিযুক্তের শাস্তি পাওয়ার প্রশ্নে আশাবাদী হতে থাকে। কিন্তু, CBI হেপাজতে থাকাকালীন গত ১২ই ডিসেম্বর লালন শেখের মৃত‍্যু হয়। CBIএর বক্তব‍্য অনুযায়ী, লালন গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত‍্যা করেছে। আর, এই খবর প্রকাশের সঙ্গেসঙ্গে নরকের দরজা খুলে গেছে! লালনের পোস্টমর্টেম করা দেহ তার পরিবার গ্রহণ না করে দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেমের দাবী জানায় যা কোর্ট মেনে নিয়েছে। লালনের পরিবার লালনকে CBI খুন করেছে বলে রাজ‍্য পুলিশের কাছে FIR করে। পুলিশ সক্রিয়তার সঙ্গে এই FIR নিয়ে তদন্ত শুরু করতে চায়! এই রাজ‍্য পুলিশই টিএমসির বিরোধী রাজনীতির তরতাজা যুবক, যাদের বিরুদ্ধে কোন অপরাধের অভিযোগ পর্যন্ত ছিল না, তাদের রহস‍্যজনক মৃত‍্যুর পর ঝুলন্ত দেহের পোস্টমর্টেম করিয়ে সাথেসাথে আত্মহত‍্যা বলে সিলমোহর দিয়েছে! সে সময় বিরোধীদের কোন অভিযোগ পুলিশ ত দূরের কথা, টিএমসির সর্বাধিনায়িকা পুলিশমন্ত্রী এবং মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায় পর্যন্ত রাজ‍্য পুলিশের পক্ষে সাফাই ণগেয়েছেন! এ ধরনের মামলায় যেখানে শাসকদল টিএমসির লোকজন অভিযুক্ত, একজনেরও আদালতে শাস্তি হয়নি! মনে রাখতে হবে, আদালতে কেস সাজানো এবং যথাযত তদন্ত রিপোর্ট পেশের দায়িত্ব রাজ‍্য পুলিশের। তারা যদি এমনভাবে কেস সাজায় যে অপরাধ প্রমাণিত হবে না – তখন আদালতের কিছু করার থাকে না। রাজ‍্যে বিভিন্ন রকমের দুর্ণীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি – এসবের অনেক কারন, যুক্তি থাকতে পারে – এখানে সেসব বিবেচ‍্য নয়। উল্লেখিত পরিসংখ্যান বলছে যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ, এমনকি খুন পর্যন্ত করেও অপরাধী বিশেষ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে পার পেয়ে বহাল তবিয়তে মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে পারে! এর ফলে সমাজে যে বার্তা এসেছে, তা হল, বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে থেকে সমাজবিরোধীরা সমস্ত রকম অপরাধমূলক কাজ করতে পারে! এতে রাজ‍্যের আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি না হলেও চরম মাৎসন‍্যায় যে চলছে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এখানে বড় রকমের লগ্নি দূরের কথা, সামান্য ছোটখাট ব‍্যবসা করতে গেলে পর্যন্ত এত পরিমাণ “কাটমাণি” দিতে হয়, আখেরে ব‍্যবসা অলাভজনক হয়ে পড়ে!
কলকাতায় এই মূহুর্তে ছোট চার চাকা গাড়ির পার্কিং ফি দশ টাকা প্রতি ঘন্টা। অথচ সব জায়গায় নূন‍্যতম কুড়ি টাকা নেওয়া হচ্ছে! এসব ক্ষেত্রে পুলিশে নালিশ জানানোর বা পৌর-নিগমে নালিশ জানানোর সহজ পন্থা জানা নেই। নিউমার্কেটে রাস্তা জুড়ে হকাররা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে ব‍্যবসা করছে। পৌরমন্ত্রী দূরের কথা, রাজ‍্য সরকারের এইসব হকার, যারা আবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কর্মী বটে, তাদের হটানোর ক্ষমতা নেই! এদের দৌরাত্মে নিউমার্কেটের ভিতরের দোকানগুলির বিক্রিবাটায় মন্দা এসেছে। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। যেটা বলার তা হল, এই রাজ‍্য সরকার লুম্পেন, অপরাধী ইত‍্যাদিকে ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, নেতার মর্যাদা দেওয়ায় তাদের অপরাধমূলক কাজকর্ম অবাধে চালানোর ইজারা দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ “দলদাস” হিসেবে কাজ করায় তাদের কর্মদক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে – পুলিশের মধ‍্যে দুর্ণীতি বাড়ছে, বিশেষতঃ এই সরকারের আমলে চাকরী পাওয়াদের মধ‍্যে। পুলিশ কর্মীরা একাধিক ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে যুক্ত থাকায় তা সংবাদ-মাধ‍্যমে খবর হয়!
এইভাবে প্রশাসনের মদতে রাজনীতির অপরাধকরন ধীরে ধীরে সামাজিক অবক্ষয়ের রূপ নেয়। সাধারণ মানুষ এ সময় ভয় ও অসহায়তায় অপরাধ সংঘটিত হতে দেখলেও অস্ট্রিচের মত মাটিতে মুখ গুঁজে থাকে। এভাবে মানুষ ঘৃণা মিশ্রিত অভিব‍্যক্তি নিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যায়। এইভাবে regimented অপরাধমূলক রাজনীতি সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
লালন শেখের মৃত‍্যু নিয়ে রাজ‍্যের মূখ‍্যমন্ত্রী প্রথমেই CBIকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন! অথচ রাজ‍্যের অনেক বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর ফাঁস ঝোলানো মৃতদেহকে যখন রাজ‍্যের পুলিশ আত্মহত্যা বলে চালিয়েছে, তখন একটি ক্ষেত্রেও তিনি পুলিশের বক্তব‍্যে অসঙ্গতি খুঁজে পাননি! লালন শেখের মৃত‍্যুতে CBIএর অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বাধাপ্রাপ্ত হবে। এতে লাভ কার? নিশ্চয়ই CBIএর নয়, বরং তার কর্তব‍্যে অবহেলায় সুনামের ক্ষতি হবে। এই ব‍্যাপারটা বিশ্লেষন করলে পুরো ঘটনা পরিষ্কার হবে। বগটুইয়ের ১০ জনকে রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে মারার পর প্রথমেই বীরভূমের টিএমসির বেতাজ বাদশা অনুব্রত মন্ডল পুরো ঘটনার দায়িত্ব বিরোধীদের উপর চাপিয়ে সাম্প্রদায়িকতার কার্ড খেলেন। এমনকি পুলিশকে সেভাবে এগোতে উপদেশ দেন! এই অনুব্রত এখন বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ধরা পরে জেলবন্দী। অনুব্রতর গ্রেপ্তারকে কটাক্ষ করে তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন দলনেত্রী মূখ‍্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ‍্যায়। যাক সে কথা। ভাদু শেখের মত দুষ্কৃতির খুনের বদলা নিতে এই দশজনকে পুড়িয়ে মারার অভিযোগের মূল অভিযুক্ত ছিল এই লালন শেখ। ভাদু টিএমসির নেতা এবং তাকে যারা মেরেছে বলে অভিযোগ, তারাও টিএমসির সমর্থক। লালন ভাদুর অনুগামী বলেই সে বদলা নেওয়ার জন‍্য এই কাজ করে বলে অভিযোগ। অনুব্রতর প্রাথমিক চেষ্টায় বগটুই হত‍্যাকান্ডকে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়ার চেষ্টার মধ‍্যেই পরিষ্কার যে টিএমসি তথা অনুব্রত বগটুই কান্ডের আসল অপরাধীদের আড়াল করে পুরো ব‍্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছে। কারন এটি একই সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা সকলেই টিএমসিপির লোক, তাদের দুদলের গোষ্ঠীদ্বন্দের ফল। এভাবে দুষ্কৃতিদের প্রশ্রয় দেওয়ার ফলে যে বিষবৃক্ষ রোপন করা হয়েছিল, এখন তার ফল ফলতে শুরু করেছে। মূল অভিযুক্ত লালন যদি CBIএর কাছে স্বীকারোক্তিতে দলের অন‍্য কোন নেতার নাম বলে দেয় বা অর্থনৈতিক গূঢ় কারন নিয়ে মুখ খোলে তবে দলের বড় নেতা বা নেতাদের অনিবার্য বিপদ হতে পারত। আবার কেন্দ্রীয় সরকারকে বুঝিয়ে এই অনুসন্ধান বন্ধ করা যাবে না – অনুসন্ধান চলছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে এবং CBI ও অন‍্য অনুসন্ধানকারী সংস্থাদ্বয় সরাসরি উচ্চ আদালতে রিপোর্ট করছে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন ভূমিকা নেই।
লালনের মৃত‍্যুর পরে রাজ‍্য পুলিশের কাছে যে FIR দাখিল করা হয়েছে তা যথেষ্ট সন্দেহজনক! এর উদ্দেশ‍্য সম্বন্ধে অন‍্য গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে! লালনকে CBI খুন করেছে বলে যে অফিসারের নাম দিয়ে তাঁকে জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে সেই সুশান্ত ভট্টাচার্য বগটুইয়ের অনুসন্ধানকারী দলের সদস‍্যই নন! তিনি অনুব্রত মন্ডলের বিরুদ্ধে গরুপাচার ও আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পদের অনুসন্ধানকারী দলের IO! সুতরাং CBIএর কোন অফিসারকে কেন ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা জলের মত পরিষ্কার। পরন্তু, ঝাড়খন্ড থেকে যখন CBI লালনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে, তখন তাকে হত‍্যার অনেক সুযোগ ছিল। CBIএর লালনকে হত‍্যার মোটিভ নেই। আবার বলা হচ্ছে, লালনের গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত‍্যার সময় তার পা নাকি মাটিতে ছুঁয়ে ছিল। এ সম্বন্ধে বলি, বিজেপি কর্মীর দেহ একই রকমভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়ার সময় যখন দেখা গিয়েছিল যে মৃতের পা মাটি ছুঁয়ে আছে, তখন রাজ‍্য পুলিশ আত্মহত‍্যার তত্ত্বে অনড় থেকে partial hanging তত্ত্বের কথা বলে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পা মাটিতে ঠেকে থাকলেও একজন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত‍্যা করতে পারে। তাড়াহুড়োয় কোন অদৃশ‍্য শক্তির অঙ্গুলিহেলনে এই FIRএর পক্ষে অ‍্যাকশন নিতে গিয়ে কি সেক্ষেত্রে দোষীকে আড়াল করার দায় রাজ‍্য পুলিশ নিজেদের ঘাড়ে নেবে! লালনকে যখন তদন্তের প্রয়োজনে তার আত্মীয়ের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে নাকি তার নিকটজনদের কাছে বলেছিল যে CBI তাকে প্রচন্ড মারধোর করেছে! CBI অফিসার ও CISF রক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত লালনের পক্ষে এমন কথা বলা অসম্ভব। এটা সর্বৈব মিথ‍্যা – এছাড়া post mortemএ লালনের শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। সবচেয়ে বড় কথা, এই লালনের বিরুদ্ধে যে খুনের প্রধান অভিযুক্তের আরোপ ছিল, তাতে তার মত একজন hardened ক্রিমিনালের পরিবার ও তার পারিপার্শিক জগতের কাছে শিশু সুলভ সরলতা আশা করা যায় না।
বরঞ্চ, লালনের মৃত‍্যুকে ব‍্যবহার করে CBIএর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার গতি বন্ধ করা বা শ্লথ করার অশুভ চেষ্টা করা যায় তবে কার লাভ তা সবাই বুঝতে পারছে। এই অশুভ শক্তির আশু প্রয়োজন সুশান্ত ভট্টাচার্যকে গরুপাচারের তদন্ত থেকে সরে যেতে বাধ‍্য করা! “রাঘব বোয়াল”কে বাঁচাতে যদি কেন্দ্রীয় সরকার রাজ‍্যের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে তবে, এই মূহুর্তে রাজ‍্যের যা পরিস্থিতি, তাতে কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের এই রাজ‍্যে নির্বাচনে ভরাডুবি অবশ‍্যম্ভাবী। মনে হয় না, ঐ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এমন ভুল করবে। সেজন‍্য অবশ‍্য রাজ‍্যে টিএমসি CBI ও ED বিরোধী আন্দোলনে রাজ‍্য সরকারের মদতের জন‍্য যথাসাধ‍্য চেষ্টা চালাবে। যেভাবে সমাজে অপরাধ ও তা আড়াল করার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ছে, তাতে আসলে মদত পাচ্ছে মাৎসন‍্যায়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া এটা বন্ধ করা অসম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *