আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাখাতে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ বেড়ে চলেছে – কেন্দ্র, রাজ্য উভয়ক্ষেত্রেই। তবু অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার অন্যান্য পীঠস্থানগুলি উৎকর্ষতা বৃদ্ধির নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে; সেখানে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার মান এবং তাদের বিশ্বের অন্যান্য দেশের নিরিখে র্যাঙ্কিংয়ের অধোগমন অব্যাহত। এর কারন অনুসন্ধানের জন্য প্রথমেই যা লক্ষ্য করা গেল তা হল, শিক্ষাঙ্গনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে রাজনীতির আঁতুরঘর বানানো। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ – ইউরোপ, আমেরিকায় – উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গনে বিচরণ করার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, এই দেশের মত শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির জন্য ব্যবহার করার বিষয় কোথাও দেখতে পাইনি।
প্রথম থেকে বলতে গেলে বলতে হয়, ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রীর নাম মৌলানা আবুল কালাম আজাদ – যিনি ভারতে নয়, মধ্যপ্রাচ্যে শিক্ষালাভ করেন। এই নিয়োগের মধ্যে দিয়েই শিক্ষাকে অবহেলা করার সূত্রপাত হয়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর পুত্র রাজীব গান্ধী – কারোর বলার মত শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তাঁরা শিক্ষামন্ত্রকের বিষয়ে উন্নতির জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক কারন মোতাবেক নিতেন। এই সময়, অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বের পরের দিকে এবং রাজীব গান্ধীর পুরো সময়ে ও তারপরেও দলের হাল রাজীবের পত্নী সোনিয়া গান্ধীর হাতে থাকার সময়ে ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ন্ত্রণ করার মত জনসমর্থন না থাকলেও ভারতের বামপন্থীরা, বলা ভালো, কম্যুনিস্টরা বিভিন্ন বিভাগে কংগ্রেসের দালালী করার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতার মধুভান্ডের ভাগ এবং বিভিন্ন নীতি নির্ধারণের বিষয়ে তাদের জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে সফলভাবে লবিং করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে হয়ত গান্ধী পরিবারের ধারনা ছিল – এই দপ্তরে কোন উল্লেখযোগ্য মধুভান্ড নেই! সেজন্য সমাজবাদীর ভেকধারী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধী শিক্ষার নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ণে তাঁদের কাছের কম্যুনিস্টদের উপরেই নির্ভর করেছিলেন। এর আগে একাধিক লেখায় দেখানো হয়েছে যে, তাসখন্দে ১৯২০ সালে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি গঠনের প্রথম দিন থেকেই এরা জেহাদী ইসলামকে প্রাধান্য দিতে শুরু করে। ক্রমে ভারতের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে এবং পরে স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণে হিন্দু গণহত্যার নিন্দা না করে ও পাকিস্তান গঠনের জন্য ভারতের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এরা নিজেদের ভারত বিরোধী চরিত্রের প্রমাণ দেয়। ২২শে আগস্ট, ১৯৪৬ সালে যুগান্তর পত্রিকায় তদানীন্তন কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশীর বক্তব্য প্রচারিত হয়, যেখানে তিনি জেহাদী মুসলিম তোষনের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি এ্যটলী অব্দি পি সি যোশী ও তাঁর কম্যুনিস্ট পার্টিকে বৃটিশদের সহযোগী বলেছেন। কম্যুনিস্টদের INA ও সুভাষচন্দ্র বসুর বিরোধীতা, বাংলা ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের বিরোধীতা, হিন্দু ও তাদের জন্য লড়াই করা হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর বিরোধীতা এবং সেইসঙ্গে জিন্নার মুসলিম লীগের সমর্থনে এগিয়ে আসার বহু নিদর্শন আছে। একটি ব্যাপারে কম্যুনিস্টদের প্রশংসা করতে হয় – যতই ভারত ও হিন্দুবিরোধী এবং জেহাদী মুসলিমদের, বিশেষতঃ ভারতের বিরুদ্ধে লিপ্ত জেহাদীদের সমর্থন করার ফলে তাদের ভারতীয় রাজনীতিতে জনভিত্তি ক্ষীয়মাণ হতে থাকুক, তারা তাদের এই ভারতবিরোধী নীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি।
এবার শিক্ষার ব্যাপারে কংগ্রেসী পরিবারতন্ত্রের কৃপায় তাদের প্রবেশকে তারা পূর্ণমাত্রায় নিজেদের এজেন্ডা ও নীতির প্রসারে ব্যবহার করতে লাগল। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় বা হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রত্যেকটিতে শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র মানদন্ড ছিল কোন কম্যুনিস্ট দলের প্রতি বিশ্বস্ততা! এমনকি উচ্চশিক্ষায় সর্বোচ্চ পদগুলিও এভাবে পূর্ণ করা হতে লাগল। ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন করার সময় এক কম্যুনিস্ট দলের অন্যতম শীর্ষ নেতার জামাইকে আই আই এম আহমেদাবাদের ডিরেক্টর পদে বসানো হল। এটা একই সঙ্গে কম্যুনিস্টদের গুণ এবং বিরোধীদের অপদার্থতা যে, ধীরে ধীরে শুধু কম্যুনিস্ট শিক্ষক নিয়োগই নয়, বিভিন্ন বিষয়, বিশেষতঃ ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মত বিষয়গুলির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস নিজেদের মত করে বদলে ফেলতে লাগল। যেমন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে ঢোকানো হল চীন ও রাশিয়া। ইতিহাসের স্কুল লেভেল থেকেই সিলেবাসের অভিমুখ বদলে দেওয়া হল। ১২শ শতাব্দীর আগের, অর্থাৎ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের গুরুত্ব সিলেবাসের ভার কমানোর নামে কমিয়ে দেওয়া হল। বাড়ানো হল ইসলামী যুগের ইতিহাস। এটার উদ্দেশ্য, দেশের হবু নাগরিকদের মধ্যে যাতে জাতীয় অস্মিতার বোধ তৈরী না হয় – তাহলে জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রভাব তাদের মধ্যে পড়বে না। তাছাড়া, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংগ্রামকে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকরভাবে দেখানো হল। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন ছিল বিনা প্ররোচনায় আক্রমণকারী – একথা অনুচ্চারিত থেকে গেল। ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে ভারতের কৃষ্টি ও সভ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হল বিদেশী সভ্যতাকে – আধুনিকতার নামে এইভাবে দেশের নতুন প্রজন্মের ব্রেনওয়াস করা শুরু হল। অদ্ভুত একটি দলিত-মুসলিম ঐক্যের তত্ত্ব প্রচার করা শুরু হল। এই চেষ্টা প্রথমে দলিত সম্প্রদায়কে ভারত বিদ্বেষী করার জন্য মুসলিম লীগের প্রচেষ্টা ছিল। এভাবে মিথ্যা প্রচার সম্বৃদ্ধ কিম্ভুত কিমাকার সিলেবাসে শিক্ষা পাওয়ায় পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে দেশাত্মবোধক চেতনার বিকাশ পরিকল্পিতভাবে বাধাপ্রাপ্ত হল। এইসঙ্গে তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পাঠ নেওয়া হিন্দু ছাত্ররা নিজেদের ধর্মকে অবজ্ঞা করার পাশাপাশি অন্য ধর্ম অর্থাৎ ‘ইসলাম’কে সম্মান জানানো তাদের আধুনিক শিক্ষার অঙ্গ হিসাবে দেখতে লাগল। বিশেষভাবে কম্যুনিস্ট শাসিত কেরল, বাংলা ও ত্রিপুরায় এবং তার সাথে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এদের দাপাদাপি বেড়ে গেল। একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বামপন্থী রাজনীতির আঁতুরঘর বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন JNU, হায়দ্রাবাদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। গত দু এক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সংবাদের শিরোনামে এসেছে শুধুমাত্র অ-শিক্ষাজনিত দেশবিরোধী রাজনীতি ও বামপন্থী এ্যজেন্ডার সমর্থনে আন্দোলনকারী হিসেবে।
এখানে অল্প কথায় বলে নিই – এই একই সময়ে একটি নতুন বিষয় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চালু হয় – জার্নালিজম ও মাস কম্যুনিকেশান। সংগঠনবৃদ্ধির পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে এই বিষয়ের পাঠদানকারী শিক্ষক থেকে ছাত্র, সবেতেই বামপন্থীদের বিপুল সংখ্যাধিক্য হওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যে সংবাদ মাধ্যমগুলি (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক দুইই) বামপন্থী মনোভাবাপন্ন কর্মীতে ভরে গেল। এই সময় বামপন্থীরা বাংলা ও ত্রিপুরায় ক্ষমতায় থাকার ফলে এই দুই রাজ্যের সংবাদ মাধ্যম ত বটেই, কেন্দ্রের কংগ্রেসের কাছাকাছি থাকা জাতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলির মালিকপক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক কারনে কংগ্রেস অনুমোদিত শিক্ষার বামপন্থায়ণ সমর্থন করার নীতি নিল। সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমগুলিতে বামপন্থীমুখের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে আরম্ভ করল – তথাকথিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব চয়ন ও বিশেষজ্ঞ চয়নেও বামপন্থী সংখ্যাধিক্য দেখা গেল। অবশ্য সময়ের সঙ্গেসঙ্গে এদের মধ্যে অনেকে ব্যক্তিগত সমীকরনের কারনে বামপন্থার বিরোধীতা করতে লাগল। এই পুরো সময় ধরে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি আশ্চর্যজনকভাবে শিক্ষার এই বামপন্থায়ণ ও তার গূঢ় উদ্দেশ্য সম্বন্ধে উদাসীন ছিল। এখনো তাদের তরফে কোন সদর্থক পদক্ষেপ নজরে আসেনি।
এইভাবে কম্যুনিস্ট ভাবধারার সম্প্রসারণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হল শিক্ষা বিভাগ। এখানে স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর সময়ে শিক্ষানীতিতে একটি বিষয়ে অভিমুখের কোন বদল হল না। আমাদের দেশে বৃটিশ আমলে আধুনিক শিক্ষানীতি প্রথম শুরু করেন মেকলে সাহেব। তাঁর শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল – ইংরেজী শিক্ষায় ছাত্রদের শিক্ষিত করা, এছাড়া শিক্ষার মধ্যে কঠোরভাবে সিলেবাসভিত্তিক নোটসর্বস্ব শিক্ষা – যা ছাত্ররা মুখস্ত করে পরীক্ষায় উগরে দেবে! এর ভিত্তিতেই ছাত্রদের মূল্যায়ণ। সতর্ক দৃষ্টি ছিল যাতে দেশাত্মবোধক চেতনা এবং দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে ছাত্ররা বিশেষ শিক্ষা লাভের কোন সুযোগ না পায়। এর কারন হল দেশীয় নেটিভদের ততটুকু শিক্ষাদান যাতে তারা দেশ শাসনে সাহেবদের হাত হিসেবে হুকুম তামিল করতে পারে। এই শিক্ষায় বুদ্ধির বিকাশ ও সঠিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা বিকাশের কোন চেষ্টা ছিল না। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টরা যখন কংগ্রেসের সহযোগীতায় দেশের শিক্ষানীতির দায়িত্ব নিল তখন তাদের উদ্দেশ্য ছিল নেতা তৈরী করা নয়, ক্যাডার তৈরী করা। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তারা মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষানীতির কোন মৌলিক পরিবর্তন করল না। শাসক সর্বদা হুকুম তামিলদার প্রজা চায় – প্রজার প্রশ্ন করা শাসকের নাপসন্দ। এ কারনে সত্যিকারের শিক্ষার বদলে সেই নির্দিষ্ট সিলেবাস মুখস্তের শিক্ষা চলতে লাগল! সঙ্গে জুড়ল বিদেশী কম্যুনিস্টদের গুণগান, অবশ্য বিশেষ কয়েকজন কংগ্রেসী নেতা ও কংগ্রেসের সর্বশক্তিমান পরিবারের সদস্যদের আত্মত্যাগের কাহিনীও সিলেবাসে ঢুকল! বলা হল, এটাই আসল স্বাধীনতা সংগ্রাম! অর্থাৎ বৃটিশদের থেকে এই ভারতীয় শিক্ষায় উত্তরণ হল অশিক্ষা থেকে কুশিক্ষায় সন্তরন।
এই বিষবৃক্ষের ফল যথা সময়ে ফলতে শুরু করল। প্রথাগত শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি লাভের সঙ্গে শিক্ষিতদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কারনে রোজগার করতে পারার কোন সম্পর্ক রইল না। ফলত শিক্ষার গুরুত্ব কমতে লাগল – শিক্ষা আলঙ্কারিক শোভার মত ডিগ্রি পাওয়ায় পর্যবসিত হল। এদিকে যথার্থ যোগ্যতা না থাকায় ভারতীয় শিক্ষায় শিক্ষিতরা বিশ্বের শিক্ষার দরবারে সকল প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পরতে লাগল। এই ব্যধি দূর করার চেষ্টা না করে দেশের নেতা, নেত্রী থেকে আমলারা নিজেদের সন্তান-সন্ততিদের ছোট বয়স থেকে আমেরিকা, ইউরোপ বা নিদেনপক্ষে এশিয়ার সেরা শিক্ষার জায়গা জাপান, সিঙ্গাপুর বা দক্ষিণ কোরিয়ায় নামী, দামী শিক্ষায়তনে ভর্তি করিয়ে দিলেন! আমি কম্যুনিস্ট সহ বিভিন্ন দলের নেতা নেত্রীদের মধ্যে এই ধারা লক্ষ্য করেছি। এরা আবার বিদেশী ডিগ্রিধারীদের (তা সে মামুলি শিক্ষায়তন থেকে হলেও) দেশের ডিগ্রিধারীদের তুলনায় বড় মনে করেন! ইংরেজের দাসত্বের মানসিক বন্ধন এদের ঘোঁচেনি। আমাদের দেশের এই শিক্ষা ব্যবস্থা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা নয় – হলও না। এদিকে, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষকদের উন্নত বেতন বরাদ্দের কোন খামতি হল না! যেমন প্রশাসনিক পদের অফিসারদের যোগ্যতা বিচার না করে সময়ের সাথে সাথে উচ্চতর পদে নিয়োগ হয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেই একই ব্যাপার দেখা গেল। আবার, ছাত্রদের মূল্যায়ণে তাদের মুখস্ত বিদ্যার প্রতিফলন হলেও এধরনের শিক্ষা পদ্ধতিতে মেধার মূল্যায়ণ করা যায় না।
এইভাবে স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতি যখন মানুষের বিশ্বাস হারাতে চলেছে তখনই এল অতিমারীজনিত লকডাউন। তার ফলে সমস্ত শিক্ষায়তনে প্রায় দু বছর শিক্ষাদান বন্ধ থাকল, শুধু ‘অনলাইন শিক্ষা’র মত ছেলেভোলানো শিক্ষাদান খেলা চলল। কিন্তু যথাসময়ে পরীক্ষা সমাধা হল! আচ্ছা, ল্যবোরেটরী নির্ভর বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলির হাতে-কলমে কোন ক্লাশ হল না, কিন্তু পরীক্ষা হল! এই ভোজবাজীর শিক্ষা ব্যবস্থা পি সি সরকারের ম্যাজিককেও হার মানায়।
আবার ডাক্তারী শিক্ষার ক্লাশও একই কারনে বন্ধ। ছাত্ররা কিভাবে অনলাইনে ক্লিনিক্যাল ও সার্জারীর মত বিষয় আয়ত্ত করল তাও এক ধাঁধা! এভাবে মৃতপ্রায় শিক্ষা ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করা হল। ফলে, এই মূহুর্তে দেশে সমস্ত স্তরে ছাত্রসংখ্যা ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতে এই শিক্ষানীতির প্রবক্তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
কংগ্রেস দল চেয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস শুধু গান্ধীজী ও তাদের দলের শীর্ষ পরিবারকে ঘিরে লেখা হোক – ছাত্ররা তেমন ইতিহাসই জানুক। আর কম্যুনিস্টদের সুচতুর নীতিতে ভারতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে যেমন শিক্ষিত যুব সমাজের সঠিক ধারনা তৈরী হল না, তেমনি ইসলামী দখলদারীকে নরমভাবে দেখিয়ে মুঘলদের ভারতীয় বানানোর অপচেষ্টা করা হল। বিদেশী স্থপত্যবিদদের বিধানেও তাজমহলের নির্মানে কোন মৌলিক চিন্তার পরিচয় না থাকলেও তাকে শ্রেষ্ঠত্বের তকমা দেওয়া হল! এভাবে কম্যুনিস্টদের শতাব্দী প্রাচীন নীতি – ভারতবিদ্বেষ ও হিন্দুবিদ্বেষের আগুন জ্বালানোর আবহ তৈরীর চেষ্টা হতে লাগল। এর ফলে তথাকথিত শিক্ষিত যুবসমাজকে উত্তেজিত করে দেশবিরোধী শক্তির হাত শক্ত করার চেষ্টা হল। ধর্মনিরপেক্ষতার বামপন্থী ব্যখ্যা অনুযায়ী হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষার স্কুল, কলেজ খোলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হল। একইসঙ্গে মুড়ি মুড়কির মত বিভিন্ন জায়গায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, মাদ্রাসা খুলে ইসলামী শিক্ষায় সরকারী সহযোগীতা শুরু হল। মাদ্রাসা শিক্ষা বুনিয়াদী স্তর থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত হল। ফলে, দেশে হিন্দু ধর্মীয় উন্মাদনা হ্রাস পেলেও ইসলামী ধর্মীয় উন্মাদনা বৃদ্ধি পেল। যেমন ভগবানের ধর্মীয় শিক্ষায় মানুষ ঋদ্ধ হয়, তেমনি যথার্থ আল্লার ধর্মীয় শিক্ষায়ও মানুষ ঋদ্ধ হয়। কিন্তু এইসব মাদ্রাসার মাধ্যমে আল্লার শিক্ষা নয়, মৌলভীদের শিক্ষা যা বিধর্মীদের ঘৃণা করতে শেখায় – ভারতকে শত্রুদেশ ভাবতে প্ররোচিত করল। এর ফলে হিন্দু বিরোধীতার আগুনের স্পর্শে মুসলিম বিরোধীতার আগুন জ্বলল। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা হল। এটাই এই শিক্ষানীতির প্রণেতারা চেয়েছিলেন! অথচ ভারতীয় মুসলমানদের জন্ম, ধর্মকর্ম সবই ভারতে। তাঁরা ভারতীয় হিন্দুদের মতই ভারতীয়। শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরনের দেশের স্থায়ীত্ব বিরোধী কাজকর্ম হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারন মানুষ প্রত্যাখ্যান করায় শিক্ষার দ্বারা ব্রেনওয়াশের কংগ্রেস-কম্যুনিস্ট যৌথ কৌশল তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বে ধ্বস নামালো।
সে কারনে একটি নতুন শিক্ষানীতি ও সেইসঙ্গে শিক্ষার অভিমুখ বদল করার আশু প্রয়োজন হল। মেকলের শিক্ষানীতি থেকে বর্তমান শিক্ষানীতি অব্দি যে জিনিষটার অভাব ছিল, মেধার বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা শুরু হল। এই শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা গৃহীত হওয়ার পর এখনো চালু হয়নি বলে এর ভালোমন্দ বিচারের সময় এখনো আসেনি। অবশ্য কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের ও UGCর বিভিন্ন সার্কুলারে এ সম্বন্ধে এখনো অনেক ধোঁয়াশা বিদ্যমান। সময় এর উত্তর দেবে। তবে, শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত করা আশু প্রয়োজন – না হলে কোন শিক্ষা ব্যবস্থাই সার্থক হবে না।
স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতি কার স্বার্থে
