ভারতীয় সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় ছ’টি মৌলিক অধিকারের কথা স্থীকৃত – বক্তব্য বা মতামত বলা ও লেখার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ জমায়েত ও সংঘ গঠনের স্বাধীনতা, দেশের যে কোন স্থানে ভ্রমণ ও বসবাস করার স্বাধীনতা এবং পেশার স্বাধীনতা। এগুলোই মৌলিক অধিকার হিসাবে সকল নাগরিকের প্রাপ্য। এখানে কোথাও ইসলামী বা অন্য মহিলাদের হিজাব বা বোরখা পড়ার অধিকারের কথা বলা নেই। অথচ, প্রবীণ কংগ্রেসী ও প্রাক্তণ মন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া ‘হিজাব’কে ইসলামী মহিলাদের “মৌলিক অধিকার” বলেছেন! সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচোরই বলেছেন, হিজাব নাকি সাংবিধানিক অধিকার! তা সীতারামজী এই অধিকার ভারতীয় সংবিধানের কিনা সেটা বলেননি! তাঁর জ্ঞাতার্থে জানাই, ২০১৭ সালে তাঁর রাজনৈতিক পিতৃদেবের দেশ, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তাদের দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি হিজাব উত্তর কোরিয়া ও বেশ কিছু ইউরোপীয় দেশে নিষিদ্ধ। ইসলামী দেশগুলির মধ্যে সংযুক্ত আরব আমীরশাহীতে হিজাবের বাধ্যবাধকতা নেই। আমেরিকাতে সুরক্ষার প্রশ্নে হিজাব খোলা বাধ্যতামূলক। সাম্প্রতিক কালে বোরখা ও হিজাবের প্রতিবাদে ইরানের মহিলাদের বলিষ্ট প্রতিবাদ সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। এই আন্দোলনে ইরান উত্তাল। অথচ, ভারতের মত দেশ, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধান স্বীকৃত, সেখানে এই দেশের কতিপয় রাজনীতিক সংবিধানের নামে মিথ্যা দোহাই দিয়ে আসলে জিহাদী ইসলামী নেতৃত্বকে তুষ্টিকরনের বার্তা দিচ্ছেন।
কিন্তু কেন? এরা ভালো করেই জানেন যে, পৃথিবীতে যে কটি ইসলামী রাষ্ট্র আছে, তাদের কোনটিতেই স্বীকৃত কোন কম্যুনিষ্ট দল নেই! সুতরাং, এই কম্যুনিষ্টদের উদ্দেশ্য ভারতে ইসলামী শাসন কায়েম করা নয়, তাদের উদ্দেশ্য ভারত-বিরোধী জিহাদী শক্তির তুষ্টিসাধন। এইভাবে তারা ভোট রাজনীতির ময়দানে তাদের ভোট-ব্যাঙ্ক স্ফীত করতে আগ্রহী। আবার হিন্দু ভোটারদের জন্য তাদের টোপ হল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। এই “ধর্মনিরপেক্ষ” ও “সমাজতান্ত্রিক” কথাদুটি আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৯৭৬ সালে ‘জরুরী অবস্থা’র সুযোগে সংসদে সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের বৃহত্তম সংশোধন করে ঢোকান। রাষ্ট্রের নাম – সমাজবাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী ভারত – ঘোষিত হল। ইন্দিরা গান্ধীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও, তাঁর অনুচরবর্গের শিক্ষার দৈন্যতা এতটাই য তাঁরা দেশের সব নাগরিককেই মূর্খ ভাবার ধৃষ্টতা দেখালেন। “সমাজবাদী প্রজাতন্ত্র” বা “গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” থাকলেও (ইংল্যান্ড একমাত্র দেশ যেখানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র আছে) সমাজবাদী গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কি করে সম্ভব তা একমাত্র সোনার পাথরবাটির মত লাগছে! ভারতের কম্যুনিষ্ট নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের “ধর্মনিরপেক্ষতা”র বড়ি খাওয়াতে নানাভাবে চেষ্টা করেছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে কোরান ও বাইবেল সরাসরি নিন্দা করায় কোন ইসলামী বা খ্রীষ্টান ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না! শুধুমাত্র হিন্দুদের ধর্মহীণতায় উদ্বুদ্ধ করার জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতার অবতারণা করা! কম্যুনিষ্টদের কাছে হজ করা, ঈদের রমজানের উপবাস ও নমাজ পড়া ইসলামীদের মতই জায়েজ। শুধু দূর্গাপুজার মন্ডপ জুতো দিয়ে সাজানো, পুজো মন্ডপে আজান দেওয়া ও কোরান রাখা “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নিদর্শন! এরা কখনো মসজিদে হনুমান চালিশা বা গীতা পাঠ করতে বলে না। এদের কাছে মক্কায় অমুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ জায়েজ। এদের কানে সন্ধ্যারতির আওয়াজ অসহ্য লাগলেও এরা কখনো লাউড স্পিকারে নমাজের আওয়াজে বিরক্তি বোধ করে না। এভাবেই এরা ভারতে “ধর্মনিরপেক্ষতা”র নামে ইসলামী ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচার চালান শুধুমাত্র হিন্দু মননে নিজ ধর্মের প্রতি বিরূপতা জাগানোর চেষ্টায়।
এভাবে ভারতীয় কম্যুনিষ্টরা জিহাদী ইসলামের স্বার্থরক্ষা করতে করতে কখন যেন হিন্দু-বিদ্বেষী থেকে ভারত-বিদ্বেষী হয়ে গেল! আর কংগ্রেস সম্পর্কে বলতে হয়, একটি গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রীষ্টান পরিবারের অধীনে এই শতাব্দী প্রাচীন দলটি এখন রাজনীতির আই সি ইউতে অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলার অপেক্ষায়। এর নেতারা সকলেই ঐ পরিবারকে খুশী করার সাথে সাথে হিন্দু-বিদ্বেষের মাপকাঠিতে নিজেদের যোগ্যতাকে বিচার করার মাধ্যমে ঐ পরিবারের সন্তুষ্টি বিধানে ব্যস্ত।
এই মূহুর্তে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিরোধী দলগুলির নীতি নির্ধারণে এই কম্যুনিষ্টদের হিন্দু-বিরোধী নীতিকে প্রাধান্য দেওয়ায় তারা প্রায়শঃই ভারত-বিরোধী লাইন নিয়ে ফেলছে। এর ফলেই দেশে ধর্মীয় মেরুকরণ তৈরী হচ্ছে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার মত রাজনীতি সচেতন, শিক্ষিত ভোটারদের রাজ্যেও এই মেরুকরণ দেখা যাচ্ছে।
এইসব বিরোধী নেতারা ভারতীয় হিন্দু রমনীদের চিরাচরিত বেশভূষায় নাকি গেরুয়াকরণের ছাপ দেখছেন! তারা গেরুয়া রংয়ের ওড়না ও দোপাট্টার বিরোধী! তারা কি একবারও মনে করেছে যে, দেশের জাতীয় পতাকার সবচেয়ে উপরের রং গেরুয়া! তারা কি গৈরিকীকরণের প্রতিবাদ করে দেশের পতাকার রংটাই পাল্টে দেবে!
আসলে এসব করার সুযোগ হয়েছে ঐ ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধনের জন্য। এখানেই ভোট সর্বস্ব রাজনীতির সংসদকে সর্বশক্তিমান বানানোর প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়। সংবিধানের ৪৪তম ধারার (৪২তম সংশোধন) বিপুল সংশোধন করে পরবর্তী সময়ে কম্যুনিষ্টদের দাপটে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে জিহাদী অনুপ্রবেশ শুরু হয়। আরবী সংস্কৃতির আদলে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ধীরগতিতে পরিবর্তন আনা হয়। রামধনু হয় রংধনু, জল পান করা হয়ে যায় পাণি খাওয়া, জলখাবার পাল্টে হয় নাস্তা করা! শ্যালিকা হয় বেয়াইন, “তোমায় দেখে নেব” কথা হয়, “তোমার খবর আছে” ইত্যাদি। হারিয়ে যায় ইসলামী বাঙ্গালীর মধ্যে বাউল গান, ঝুমুর গান – জায়গা নেয় মেহফিল আর মুজরো মার্কা জলসা। তারপর বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয় ‘লাভ জিহাদ’। হিন্দুদের মধ্যে, বিশেষতঃ বাঙ্গালীদের সঙ্গে বহিরাগত ইসলামীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস না থাকায় এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে বিশেষভাবে গান্ধী-নেহরুর বাংলা বিদ্বেষের ভুরিভুরি উদাহরণে বাঙ্গালী হিন্দুর সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বৃহত্তর হিন্দু সমাজের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মিলনের পথে কিছুটা বাধা উপস্থিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের মধ্যে কম্যুনিষ্ট ও তার উত্তরসূরী এই জায়গাটাই exploit করতে শুরু করে। তারা হিন্দু ঐতিহ্য ও লোকাচারকে ভুলিয়ে দিতে বাঙ্গালী হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে “উৎসব” মুখী করে নতুন সংস্কৃতি আমদানি করে – হিন্দুত্বের শিকড় উপড়ে ফেলার কৌশল। সেখানে “অকাল বোধন” এর দূর্গাপুজা হয়ে যায় দূর্গোৎসব যা শুরু হয় পিতৃপক্ষে! আবার সরস্বতী পুজাকে বাঙ্গালীর ভ্যালেন্টাইনস্ ডে হিসাবে দেখিয়ে পুজার মাহাত্ম্য অস্বীকার করা হতে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই – হিন্দুদের ধর্মীয় ব্যাপারটা নষ্ট করে দাও; হিন্দু ধর্ম ঘেঁটে ঘ হয়ে যাক! হিন্দুদের দেবদেবীর অপমান ও পুজাকে তাচ্ছিল্য করার অছিলা একটাই – ধর্মনিরপেক্ষতা! আবার, ইসলামী বা খ্রীষ্টীয় ধর্মের কোন রকম লঘুকরনের এরা বিরোধী – অজুহাত – সংখ্যালঘুর ধর্ম রক্ষা! এভাবে একটি ধর্মের অবমাননা ও অন্য ধর্মের রক্ষা করা – এর নামই কম্যুনিষ্ট চর্চিত ও কংগ্রেস প্রযোজিত “ধর্মনিরপেক্ষতা”।
ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে এরা উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের প্রিয় চর্চার বিষয় করে তোলে হিন্দু দেবদেবী ও অবতারদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে আক্রমণ করা। কোন প্ররোচনা ছাড়া এমন অযৌক্তিক আক্রমণের কারন হচ্ছে হিন্দুধর্ম এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে হিন্দুত্বকে আক্রমণ করা। আশ্চর্য বিষয় হল, এরা ভুলেও কখনো ইসলামীদের উপাসক বা তাদের অবতারদের নিন্দা করা দুরের কথা, এ বিষয়ে আলোচনাকে অব্দি ‘গুণাহ্” মনে করে। কাজেই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মুখোশ পরে একদল মানুষ সমাজের বৃহত্তর অংশের হিন্দুদের ধর্মকে নষ্ট করে দেশের সংহতিকে আঘাত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে, যেখানে এদের সহযোগী রয়েছে ভারত-বিরোধী জিহাদী শক্তি – যারা নিশ্চিতভাবেই প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে মদত পাচ্ছে।
একটা ব্যাপার কখনো মাথায় ঢোকে না – যারা সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে, তাদের জিজ্ঞাসা করি, দূর্গাপুজায় মাতৃ আরাধনাতে কি কোন ইসলামী মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারেন? কারন, ইসলামে কোন দেবীরূপ স্বীকৃত নয় – মহিলারা “শষ্যক্ষেত” মাত্র – একথা একাধিক ইসলামী পন্ডিতের কাছে জেনেছি। কাজেই দূর্গাপুজায় ইসলামীদের অংশগ্রহনের অভিনয় হয়ত থাকবে, কিন্তু যথার্থ অংশগ্রহন থাকবে না। আবার ঈদের রমজানের উপবাসের পর রোজা ভাঙ্গার ইফতারে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ অভিনয় হতে পারে, তা কখনোই ধর্মীয় অনমোদনের ইফতার নয়। ইফতারে তারাই থাকতে পারে, যারা সবশক্তিমান আল্লার সেবক এবং রমজানের উপবাস রেখেছে। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির নামে দেশের স্থায়ীত্বের উপর আঘাত করার আরো একটি পরিকল্পনা হল – দেশের কোন রাষ্ট্রধর্ম না থাকা! ধর্ম মানুষের সঙ্গে পশুর তফাৎ গড়ে দেয়। এদেশে এমনকি জাতীয় গান “বন্দেমাতরম্” নিয়ে পর্যন্ত আপত্তি করা হয়! এমন অসহিষ্ণুতার বাতাবরণে সহিষ্ণুতার বার্তা দেওয়া নির্বুদ্ধিতা বা চরম অসততা। এই আবহাওয়ায় হিজাব নিয়ে যে আন্দোলন, তা পুরুষ নিয়ন্ত্রিত! হিজাব যদি ধর্মীয় বাধ্য-বাধকতার জন্য হয়, তার নিদান কোরান বা হাদিস – কোথাও নেই কেন? হিন্দুধর্মের মধ্যে যেমন লোকাচারের অনুমোদন খোঁজা বৃথা, তেমনি ইসলামের ধর্মীয় বিধি পালনে হিজাব অপরিহার্য নয়। অবশ্য, যে অশুভ আঁতাত হিজাব নিয়ে শোরগোল করছে, তাদের আসল উদ্দেশ্য ইসলামী মৌলবাদের আড়ালে দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রের স্থায়ীত্ব বিঘ্নিত করা।
পরিশেষে বলি, কে কি পরবে বা খাবে তা যেমন তার নিজস্ব, তেমনি, কোন প্রতিষ্ঠান তার কর্মচারী বা ছাত্রছাত্রীদের কি ধরনের পোষাক পরে ঐ প্রতিষ্ঠানে আসবে, তার অধিকার একমাত্র ঐ প্রতিষ্ঠানের। অবশ্য, অশ্লীলতা ও অন্যের অসুবিধা না করে পোষাক পরার অধিকার শুধু সমাজে নয়, সংবিধানে অবধি স্বীকৃত। এইসঙ্গে সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে সমঝোতা বা ধর্মের দোহাই দিয়ে তার লঘুকরণ করা যায় না। এমনকি, ইউরোপ, আমেরিকায় একাধিকবার দেখেছি, পর্দানশীন মহিলাদের বোরখা খুলে পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তারা কিন্তু সেখানে কোন প্রতিবাদ করে না! ধর্মের নামে যত প্রতিবাদ সব ভারতে! এ ধরনের ধর্মীয় জিহাদের বিস্তারকরণ নিঃসন্দেহে দেশের সুরক্ষার পরিপন্থী। সেজন্য এ বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চস্তরের দায়বদ্ধতা আবশ্যক। ইসলামী সংস্কৃতির নামে আরবী সভ্যতার বিস্তারধর্মী আগ্রাসন বন্ধ করতেই হবে।
হিজাব রক্ষার আড়ালে লড়াই কিসের
