দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দ্রুত ছড়িয়ে পরেছে। প্রথমবারের লকডাউন ও মাস্ক ব্যবহার, স্যানিটাইজেশান আর সামাজিক দুরত্ববিধি বজায় রাখার যে নির্দেশাবলী জনসাধারণ মেনে চলছিল, তা গত বছরের শেষের দিক থেকেই আলগা হতে শুরু করেছিল। লকডাউনের সময় দেশের অর্থনীতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা মনে রেখে এবং সেইসঙ্গে কন্টেনমেন্ট জোনের উপকারিতা বিচার করে আমার মনে হয়, সরকার দ্বিতীয় পদ্ধতিকেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। কিন্তু দেশের যে রাজ্য, মহারাষ্ট্রে শতকরা পঞ্চাশভাগ আক্রান্ত, যেখানে রোগী ভর্তির জন্য বেড অমিল, সেখানে রাতে কার্ফু আর দিনে সবকিছু খোলা রেখে কি মহান কর্ম সাধন করছে তা আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়াতেই বোঝা যাচ্ছে।
গত বছরের প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে এবছরের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। প্রথমতঃ, এই দ্বিতীয় ঢেউ অতাস্বল্প সময়ে অনেক বেশী মানুষকে আক্রান্ত করছে। আর এর জন্য সাধারণ মানুষের অসতর্কতাকে অনেকটাই দায়ী করা যায়। নববর্ষের সময় শপিং মল থেকে রেষ্টুরেন্ট, বাস থেকে অটোরিকশা, রাজনৈতিক নেতাদের মিটিং-মিছিলের ভিড় — সবই করোনার আগের সময়কে মনে করায়। আরেকটা কথা, এই ভিড়ের মধ্যে মাত্র গুটি কয়েকের মুখে সঠিকভাবে মাস্ক লাগানো আছে। সরকার প্রথম ঢেউয়ের সময় যতটা সক্রিয় ছিল, এখন এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ততটাই উদাসীন। এর ফলে দেশে এবং অবশ্যই আমাদের রাজ্যেও মৃত্যুমিছিল শুরু হয়েছে। গত ১৫ই এপ্রিল, ২০২১, এ সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা প্রথম দু লক্ষ ছাড়ালো; একদিনে দেশে মৃত এক হাজারের বেশী। পশ্চিমবঙ্গে একদিনে মৃত ২৮ জন। এই ভয়াবহ অবস্থায় সরকার, নির্বাচন কমিশন, সবাই অপেক্ষা করছে – কবে নির্বাচন শেষ হবে! করোনার মোকাবিলা করা যে সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য নয়, তা সরকার তার কার্যপ্রণালী দ্বারাই প্রমান করেছে। দ্বিতীয়তঃ, এই বেশী সংক্রমণ ক্ষমতাযুক্ত মিউটেড করোনা ভাইরাস অতি দ্রুত ফুসফুস ও কিডনীর সবিশেষ ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। এর চিকিৎসার একটা গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ হল রেমডিসেভির – যা পশ্চিমবঙ্গে চাহিদার তুলনায় কম পাওয়া যাচ্ছে। কোন সরকারেরই এদিকে বিশেষ নজর দিতে দেখা যাচ্ছে না। এর আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। তারনর, কিডনী বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কিছুদিন বাদে সেই রোগী মারা যাচ্ছে। সুতরাং, অত্যন্ত শক্ত হাতে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করা জরুরী। এখানেই মানুষকে সচেতন করার যে কাজটা প্রশাসনের করার কথা, তা করতে প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। পুনরায় লকডাউন করার প্রয়োজনীয়তা জোড়ালোভাবে থাকলেও সেই সময় দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কোন বিকল্প পরিকল্পনা সরকারের যে নেই তা দিনের আলোর মত পরিষ্কার। এখন কেন্দ্র আর রাজ্য, উভয় সরকারই একে অন্যে
র ঘাড়ে দোষ চাপাতে ব্যস্ত। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। আপামর জনসাধারন, প্রশাসন, ও রাজনীতিকদের চুড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রথম ঢেউয়ের সময় ইটালীর “হাগ চাইনীজ” শ্লোগান ও কর্মকান্ডকে। এখনই এমন অবস্থা যে হাসপাতালে আর বেড পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বোঝার জন্য নীচের তথ্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে মোট আক্রান্ত – ৬,৫২,১১৬; এখন সক্রিয় রোগী – ৫৬,৬২১; মৃত – ১০,৫৪০। কিন্তু করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৯৬.৩ লাখ ((জনসংখ্যার ১০% মাত্র)। টীকাকরন শুরু হয়েছে ৮৪.৪ লাখের (জনসংখ্যার ৯% মাত্র)। এমতাবস্থায় রোজ কয়েকগুণ করে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে এপ্রিল মাসের শেষে এমন জায়গায় যাবে যে তখন নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে, করোনার সঙ্গে লড়াই করা প্রশাসনের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে গেলে আমরা ইটালী বা ব্রেজিলের মত অসহায় মৃত্যুমিছিল দেখতে থাকব। ১৩ই এপ্রিল থেকে ১৭ই এপ্রিল এই চারদিনে এক লক্ষের বেশী মানুষ দেশে আক্রান্ত হয়েছেন। এটা বিশ্বরেকর্ড!
আরেকটি কথা। এক বছর আগে এই কাগজেই প্লাজমা থেরাপীর কথা প্রথম লিখেছিলাম। তারপর বহু আক্রান্ত মানুষ প্লাজমা পেয়ে সুস্থ হয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমাদের রাজ্যে প্লাজমার আকাল দেখা দিয়েছে। প্লাজমা না পাওয়ার দায় কিন্তু স্বাস্থ্য দপ্তর এড়াতে পারে না। তারা সময় মত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এই অসুবিধা থাকত না। এর মধ্যে দুজন ভোট প্রার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় ঐ দুই কেন্দ্রের ভোট স্থগিত হয়ে গেছে। জানিনা, ভোট শেষ হতে হতে আরো কত প্রাণ ঝরে যাবে।
‘ল্যন্সেট’এ একটি গবেষণাপত্রে দেখলাম, সামাজিক দূরত্ব থাকলে ভাইরাস ছড়াতে পারে না এমন পুরোনো ধারণা ভুল। গবেষণাকারীদের বক্তব্য যে করোনা ভাইরাস হাওয়ায় ছড়ায়! এই তথ্য কিন্তু মানবজাতিকেই এক ভয়ংকর বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কারন, এই ধারনা সঠিক হলে মানুষ বন্ধ ঘরে কোয়ারেন্টিন থাকলেও নিরাপদ নয়। ফুসফুসের ক্ষতি হওয়ার ভয়ে সর্বদা মাস্ক পরে থাকাও সম্ভব নয়। তবে বাঁচার রাস্তা কি? যদিও সত্যি বলতে কি, এই গবেষণাপত্র যথেষ্ট প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। প্রথমতঃ, বদ্ধ ঘরে করোনা সংক্রমণের মাত্রা বেশী – পরিসংখ্যান কিন্তু তা বলে না। অবশ্য খোলা জায়গায় ভাইরাস যে বেশীক্ষণ বাঁচে না তা প্রমাণিত। কিন্তু এই বায়ুবাহিত ভাইরাসের তত্ত্ব যদি সত্যি হয়, তাহলে মাস্ক কোন সুরক্ষা দিতে পারবে না।
এদিকে আবার ৪৫ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে এখনো টীকাকরন শুরু না হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে এই অল্প বয়সীদের ক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ হ্মুহু করে বেড়ে চলেছে। ৪৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯০৩ জনের করোনা ধরা পড়ে। আর শুধু এপ্রিলের ১৫ দিনের মধ্যে এই সংখ্যাটা ১৭২৩৩ – রাজ্যের মোট আক্রান্তের ৪৮%! এই অবস্থায় জরুরী অক্সিজেন, রেমডিসেভির ১০০, এ্যাক্টিমেরা ৪০০। এগুলি সমস্ত হাসপাতালে পর্যাপ্ত স্টক রাখতে হবে। এছাড়া convalescent plasma ও monoclonal antibodies treatment এর জন্য আমাদের কোভিড হাসপাতালগুলির তৈরী থাকা উচিৎ। এছাড়া মৃদু থেকে মাঝারি স্তরের সংক্রমিত রোগীদের bamlanivimab ও eteservimab IV form এ পুশ করা যেতে পারে। FDA এটির অনুমোদন দিয়েছে। আদতে এগুলো সবই দেহে ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরীতে সাহায্য করে। এর ফলে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই যেমন তীব্রতর করা যাবে, তেমনি মৃতু্যহার নামিয়ে আনতেও এই চিকিৎসা কার্যকরী ভূমিকা নেবে।
এরমধ্যে একমাত্র আশার কথা – দুটি প্রতিষেধক টীকার ডোজ নেওয়ার পরেও আক্রান্ত হওয়ার হার শতকরা পাঁচভাগের চেয়ে কম। আমাদের দেশে যে দুটি টীকা দেওয়া হচ্ছে, কোভ্যক্সিন আর কোভিশিল্ড – দুটিরই প্রথম ডোজের পর নির্দিষ্ট সময় অন্তর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার ১০-১৫ দিন বাদে এই প্রতিষেধক টীকা সম্পূর্ণরূপে সক্রিয় হয়। এদিকে আমাদের রাজ্যে টীকা পাওয়া শুরু হয়েছে মাত্র ৯% মানুষের। সুতরাং টীকার পূর্ণ এফেক্ট পাওয়া মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। মনে হয়, এ ব্যপারে প্রশাসন যথেষ্ট সক্রিয় নয়। তাদের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা জাগানোর প্রক্রিয়া চালু করার ব্যপারে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের যথেষ্ট খামতি আছে। এইসঙ্গে অপ্রিয় হলেও একটা সত্যি কথা বলা ভালো – দেরী হওয়ার আগে আমাদের সম্পূর্ণ লকডাউন ছাড়া বাঁচার কোন রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। যেভাবে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, গতবছর এর অনেক আগেই পূর্ণ লকডাউন করা হয়েছিল। প্রান্তিক মানুষদের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, যেখানে এখনোলকডাউন চলছে, সেখানেও এই একই ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে। মনে রাখতে হবে,কজন মানুষ না খেতে পেয়ে মরেছে আর কজন মানুষ করোনায় মরেছে! রাজনৈতিক সদিচ্ছা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্রই যেন ভোটযুদ্ধের মাঝে ভোঁতা হয়ে গেছে।
এই অবস্থায় ভারতীয় রেল দেরীতে হলেও একটি বিজ্ঞপ্তি জারী করেছে যে মাস্কবিহীন অবস্থায় ট্রেনে ভ্রমণ করলে তা দন্ডনীয় অপরাধ এবং ঐ যাত্রীর পাঁচশ টাকা অব্দি জরিমানা হতে পারে। পাব্লিকপ্লেসে সিগারেট খাওয়ার বিজ্ঞপ্তির মত এটিও শুধু বিজ্ঞপ্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এর যথার্থ প্রয়োগ হবে তা সময়ই বলবে। এদিকে রানিং স্টাফেরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে। এখন WHO বলছে যে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেভাবে ছড়াচ্ছে তাতে গোষ্ঠীসংক্রমণ হওয়া আর দু এক দিনের অপেক্ষা মাত্র।
আমাদের রাজ্যে এই সময় আট দফার ভোট ও রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল প্রমাণ করল যে, ভোট-রাজনীতির গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের জীবনের থেকেও বেশী মূল্যবান! প্রশাসন, আধিকারিক থেকে রাজনীতিবিদ সকলেই ভোট নিয়ে ব্যস্ত। রাজ্যের নিউজ চ্যনেলগুলি ভোটের সংবাদ পরিবেশনেই নিবেদিতপ্রাণ, করোনা সতর্কীকরন প্রচার দায়সারাভাবে সেরে নিলেই হল। এর খেসারত কিন্তু পরবর্তী সময়ে মারাত্মকভাবে দিতে হবে। কারন, একমাত্র টোটাল লকডাউন করোনার দাওয়াই হলেও কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনা করে সে পথ মাড়াবে না।
পরিশেষে বাঁচার রাস্তা হিসেবে কিছু পদ্ধতি অনুসরণের কথা জানাচ্ছি। প্রথমতঃ, ঘরের বাইরে গেলে বা ঘরের মধ্যে বাইরের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য অন্তত ডাবল লেয়ার মাস্ক আবশ্যক। অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। বাইরে থেকে এলে পরনের যাবতীয় পোষাক সাবান দিয়ে কাচার ব্যবস্থা রাখুন। বিটাডাইন বা নিদেন পক্ষে নুনজল দিয়ে গার্গল করুন। তারপর সাবান দিয়ে স্নান করুন। বাইরে পরার জুতো আলাদা রাখুন। এরপর আপনার বডি ইমিউনিটির উপর নির্ভর করছে আপনি আক্রান্ত হবেন কি না।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে বাঁচার উপায়
